চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় পাকিস্তানি আমল ও বর্তমান আমল

ডা. মাহফুজুর রহমান

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১:৩২ অপরাহ্ণ

আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দুই আমলের কিছু ব্যবধান তুলে ধরছি। আমি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই ১৯৬৬ সালে। আগে থেকে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু সেখানে ছাত্রলীগ ছিল না। ছিল অগ্রগামী ও ডিএসএফ নামের দুটি স্থানীয় সংগঠন। ভর্তির আগেই আমাকে পাকড়াও করেন অগ্রগামীর মোজাহের ভাই ও অন্যরা। হঠাৎ দেখি প্রচণ্ড মারপিট। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম যারা মেরেছেন এবং মার খেয়েছেন তারা সবাই কেন্টিনে বসে একসাথে চা খাচ্ছেন। খোশগল্প করছেন।

এটা ছিল ছাত্র রাজনীতির একটি দিক। পরে  আমরা ছাত্রলীগ গঠন করি। সে কথা পরে  হবে। ৬৬ সালে ৬ দফা দেয়া হয়েছে। ৬ দফার প্রচারে  প্রধান ভূমিকা নেয় ছাত্রলীগ। স্বাভাবিক কারণে সভা মিছিলে অংশ নিতাম। কিন্তু ক্লাসে না থেকে উপায় নেই। ক্লাস করি আর সভা মিছিল করি। বিষয়টি আমাদের সিনিয়র লেকচারার দ্বিজেন স্যারের নজরে পড়ে (তিনি পরে  কোন এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে অবসরে যান)। হঠাৎ তিনি একদিন ডেকে বললেন, তুমি লেখাপড়া কর কখন?  বললাম আগে দেশ স্বাধীন হোক, পরে দেখা যাবে, আর আমিতো ক্লাস করছি। আমরা ৬ দফাকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রথম পদক্ষেপ মনে করতাম। স্যার বললেন, আন্দোলন ও লেখাপড়া একসাথে করা যায় না? তুমি ক্লাসে আস ঠিক আছে, লেখাপড়া কখন কর? বললাম, স্যার রাত ১০ থেকে ২টা পর্যন্ত পড়িতো। স্যার বললেন, তুমিতো লাশ ঘরে কম আস। তোমার গ্রুপের সাথে তোমাকে কম দেখি। আমি চুপ। এরপর তিনি বললেন, তুমি প্রতিদিন ৬টার সময় আমার কাছে আসবে। আমি তোমাকে ডিসেকশন রুমে নিয়ে যাব। পড়াবো এবং দেখাবো। আমি এরপর থেকে এনাটমি স্যারের কাছে পড়েছি। একই সাথে তিনি ফিজিওলজিও পড়াতেন। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ স্যারের কাছে। তিনি আমাকে নিবিড়ভাবে না পড়ালে এই দুই বিষয় পাশ করতে কয়েক বছর লেগে যেতো। এটা বললাম সেই সময়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বুঝাতে। শিক্ষকরা অনেক সময় কড়া ভাষায় আমাদের গালাগাল করতেন বটে, তবে সেটা নিয়ে আমরা কখনো কিছু মনে করতাম না। সে গালাগালিতেও আন্তরিকতা ছিল।

স্বাধীনতার পর এমবিবিএস পাশ করলাম। তার আগে চমেক ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের দুই অংশ। একটিকে বলা হতো মুজিববাদী ছাত্রলীগ, অন্যটিকে বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগ। দুই গ্রুপেই প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা শ্লোগান দিতাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার  জন্য। অন্যদের শ্লোগান ছিল মুজিববাদ। নির্বাচন এলো। দু’পক্ষই অস্ত্রের মহড়া দিতে থাকলো। কিন্তু কোন পক্ষই অস্ত্র চালায় না। শুধু ভয় দেখায়। আমি বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগের দলে। আর ছিলেন ডা. ইউসুফ।

আমরা দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র হিসেবে সবার চাইতে সিনিয়র। তো আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগ নেতা দিদার, জাফর, সালাহউদ্দিন, সাদাকাতউল্লাহসহ সবাইকে ডাকলাম। বললাম নির্বাচনে ব্যালট বাক্স নিতে চাইলে কিন্তু গোলাগুলি হবে। ওরা খুশিতে নেচে উঠল। কারণ ওদের ধারণা ছিল আমরা ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করবো। আর গোলমাল হলো না। জিএস ওরা পেল। ভিপিসহ সব পদ বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগ পেল। এটার উল্লেখ করলাম মারপিট ছাড়াও রাজনীতি করা যায় যদি সবাই সহনশীল হয়। এই জাতীয় আরো অনেক ঘটনা আছে।

এবার চিকিৎসা ব্যবস্থার কথায় আসা যাক। আমরা দেখেছি যে দিন যে অধ্যাপকের রোগী ভর্তির দিন থাকতো অধ্যাপকরা দলবলসহ সন্ধ্যার পর সে ওয়ার্ডে যেতেন রোগীদের দেখতেন। এখন সেটা এখন হয় কি না জানি না। একসময় আমি হাসপাতালের (কলেজের নয়) ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। ডা. ইমরান, ডা. মুলকুত, ডা. সফদার প্রমুখ মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার বা এসিসট্যান্ট রেজিস্ট্রার ছিল। তো সে সময় প্রজ্ঞাপন জারি করে হাসপাতালের রোগীদের বাইরে থেকে টেস্ট করানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এটা এখন হয় কিনা জানি না। কিন্তু সম্ভব।

মেডিক্যাল কলেজে মাঝে মধ্যে পরিচিত রোগী দেখতে যাই। বেডের চাইতে নীচে বেশি রোগী থাকতে দেখি। এটা পাকিস্তান আমলে বা আমাদের সময়ে দেখিনি। তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি ,আমাদের বর্তমান সময়ের ডাক্তাররা বেশ ধৈর্য ধরে রোগীর এই বিশাল চাপ সামাল দিচ্ছেন। এই চাপের পরও তাদের ভাল ব্যবহার আমার নজর কেড়েছে। তখন বেসরকারি হাসপাতাল ছিলই না। সম্ভবত ৭২/৭৩ সালের দিকে দুটো বেসরকারি হাসপাতাল হয়। এখন পরিস্থিতি বিপরীত। অসংখ্য উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল হয়েছে।

এবার অন্য কথায় আসি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ৫০০ শয্যা নিয়ে তার যাত্রা শুরু করেছিল। লোকবল ছিল ৫০০ শয্যার। এখন সম্ভবত এটা ১৫০০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু লোকবল ৫০০ শয্যারই রয়ে গেছে।  রোগী এখন থাকে গড়ে তিন হাজারের বেশি। ৫০০ শয্যার লোকবল নিয়ে চলছে তিন হাজারের অধিক রোগীর সেবা। এর মাঝেই ডাক্তার নার্স ওয়ার্ডবয় আয়াসহ সবাই রোগীর সেবা দিচ্ছেন। আমি বলি, জয়তু মেডিক্যাল কলেজের সবস্তরের সেবা প্রদানকারী। সরকারের দায়িত্ব কি হওয়া উচিত আপনারাই বলুন।

গ্রামের চিত্র কিছু ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর আমলে থানা পর্যায়ে প্রচুর হাসপাতাল হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয়েছে। প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯-১২/১৩ ধরনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়েছে। এই স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে পুরোপুরি কর্মক্ষম করতে পারলে বাংলাদেশের গরীব জনগোষ্ঠীর বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব। কিন্তু ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক নিয়ম এখনো চালু থাকার কারণে এটা সফলতা পাচ্ছে না। এর একটি হলো নিয়োগ ও বদলি। সাতক্ষীরার একজন ডাক্তারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োগ দিলে তিনি যেতে চান না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডাক্তারকে সেখানে নিয়োগ দিলে তিনি অবশ্যই যেতেন। নিয়োগ বদলির এই নিয়মের কারণে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের উপস্থিতি কম থাকে। এছাড়াও কোন ডাক্তার অনুপস্থিত থাকলেও দেখার কেউ থাকে না।

সবশেষে বলতে হয় পাকিস্তানি আমলের চাইতে স্বাস্থ্য সেবার পরিধি এখন অনেকগুন বেশি। প্রয়োজন আমলাতান্ত্রিক নিয়মগুলোর বদলে স্বাস্থ্য বিভাগকে আধুনিক ও স্বাধীন দেশের উপযোগী করে সাজানো। এটা করা হলে দেশের সব মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবার অধীনে আসবে। প্রশ্ন হলো সরকার এটা চান কি না?

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট