চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিক্ষায় বস্তুগত উন্নয়ন হলেও পিছিয়ে মানে

নিজস্ব প্রতিবেদক 

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১:৪৯ অপরাহ্ণ

স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হলো শিক্ষায় কিছু দৃশ্যমান সাফল্য। শিক্ষায় এই অর্জন সারাবিশ্বে এখন স্বীকৃত। প্রতি বছর গড়ে ৩৫ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে দেশে আশানুরূপ গতিতে কমেছে নিরক্ষরতা। আর এই নিরক্ষরতাকে জয় করে ফেলেছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের হার দিন দিন বাড়ছে। প্রযুক্তি শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন বাড়ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নসহ গত অর্ধশতকে শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।

২০১৯ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে- এখন প্রাথমিকে ছাত্রীদের হার প্রায় ৫১ শতাংশ, যা মাধ্যমিকে প্রায় ৫৪ শতাংশ। এটি বিশ্বে নজর কেড়েছে। তবে শিক্ষার গুণগত মানের প্রশ্নে শিক্ষাবিদদের কিছুটা অতৃপ্তি রয়েই গেছে। সংখ্যাগত দিক থেকে শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হলেও গুণগত মানের দিক থেকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছানো যায়নি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। এছাড়া শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন কিছুটা নেমে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন তাঁরা। শিক্ষাঙ্গনের তিন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এহছানুল হক।

 

 

শিক্ষা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
উপাচার্য, ইউএসটিসি

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি) চট্টগ্রামের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ৭১-এ বাংলাদেশ জন্মের পর আমাদের পড়ালেখা (প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত) বাংলায় হলো। আগেকার দিনে শিক্ষকরাই ক্লাসে প্রাধান্য পেতো। শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসে শিক্ষকদের পাঠদান শুনত। তারা প্রশ্ন করার সাহসও পেত না। আগে শিক্ষকরা ছাত্রদের বইয়ে পড়াতো, ব্ল্যাক বোর্ডে পড়াতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছড়া ছিল- আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুলতুলিতে যায়, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যায়। তখন শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে একটা সংযোগ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেটা আস্তে আস্তে টেকনোলজি বেইজড হয়ে গেছে। বর্তমানে কম্পিউটারে পড়ানো হয়, পাওয়ার পয়েন্টে পড়ানো হয়। এখন সম্পূর্ণ আইটিভিত্তিক হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আইটিভিত্তিক লেখাপড়াগুলো এখন একেবারেই হাতের মুঠোয়। আগে সেগুলো ছিল না। তবে এখনও শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখাতে হবে। ল্যাবরেটরিতে ঢুকাতে হবে। তাকে বলতে হবে বাবা তুমি গাড়ি বানাও। খেলনার গাড়ি চায়না থেকে কেন আসবে, খেলনার গাড়ি তুমি বানাবে। তাকে শেখাতে হবে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত। আমেরিকানরা কিসের ভ্যাকসিন বানাবে। আমার ছেলেরাই ভ্যাকসিন বানাবে। এখন সেই সময় চলে আসছে। তবে এখন শিক্ষকদের শেখানোর যে পলিসি সেটা আমাদের নেই। শিক্ষকরা কীভাবে পড়াবে, শিক্ষকরা পড়ানোর জন্য তাকে শেখাতে হবে। সেজন্য প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ট্রেনিং সেন্টার থাকতে হবে।

 

 

নিরক্ষরতাকে জয় করেছি আমরা

অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান

উপাচার্য, ইডিইউ

ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির (ইডিইউ) উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেছেন, প্রাথমিকে আগে এতগুলো বিভাগ ছিল না। এখন যারা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উদ্যোগ নেন, যারা উদ্যোক্তা, তারা অর্থনৈতিকভাবে উদ্যোক্তা। এককালে এই উদ্যোগগুলো নিত খুবই অল্প কিছু মানুষ- যাদের দুটো জিনিস ছিল। একটা হল- যাদের ধনসম্পদ ছিল প্রচুর, আরেকটা হল- জ্ঞান বিতরণ করার জন্য নিজেদের মধ্যে এক ধরনের আকাক্সক্ষা ছিল। তখন যারা স্কুল-কলেজ স্থাপন করেছেন তারা গ্রামীণ মানুষ। এখন সেখানে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা হচ্ছে- বিভিন্ন সূত্রে-বিভিন্ন খাতে। সুতরাং বিভিন্নখাতের লোকজন যারা আগে শিক্ষা বিস্তারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। তারা আগ্রহী হয়ে এখন স্কুল দিচ্ছেন- বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৭১-র পরে গ্রামের মানুষজনের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ সমাজও পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা আগে গ্রামীণ বলতে কৃষিখাত বুঝতাম। কিন্তু এখন কৃষি বা ধান-পাট উৎপাদনের বাইরে কৃষিতেও অনেক বিস্তার হয়েছে। বিবিধকরণ হয়েছে বা বহুধাকরণ হয়েছে। ফিশারি আগে কোন একটা ব্যাপার ছিল না। এখন বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, এখন মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শিক্ষক্ষেত্রে মাদ্রাসা আগে এত বড় আকারে ছিল না। এখন মাদ্রাসার ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি-বাংলার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালো আসন নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানিংকালে প্রমাণও আছে। আধুনিক খাতগুলো গ্রামে যাওয়ার ফলে এখন গ্রামের মানুষও আধুনিকখাতে শিক্ষাগ্রহণ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। আমরা নিরক্ষরতাকে জয় করেছি। এখন সবখানে বস্তুগত উন্নয়ন হচ্ছে। তবে শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন নেমে যাচ্ছে।

 

 

পাঠদানে শিক্ষকরা আগে বেশ আন্তরিক ছিলেন

শামসুদ্দীন শিশির

শিক্ষক প্রশিক্ষক

শিক্ষক প্রশিক্ষক শামসুদ্দীন শিশির বলেছেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে মানবিক গুণসম্পন্ন শিক্ষা মানুষের নৈতিক ও মূল্যবোধ শিক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছিল। শিক্ষকরা পাঠদানে বেশ আন্তরিক ছিলেন। শিক্ষকতাকে তাঁরা ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে আগ্রহী ছিলো এবং শিক্ষকদের মান্য করতো। শিক্ষকদের আদেশ- নিষেধকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতো। নৈতিক ও মূল্যবোধ শিক্ষার বীজ তখনই বপিত হয়েছিল। যখন তৈরি হয়েছে মানবিক গুণসম্পন্ন সোনার মানুষ, সহজ মানুষ। তখনকার বইতেও লেখা ছিল- ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’। এই ভালো হয়ে চলার শপথ শিক্ষার্থীদের ভেতর ভালো মানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্রণা দিয়েছে। তবে ৫০ বছর পরে শিক্ষকতা ব্রত নয় চাকরি হিসেবে গ্রহণ করেছেন অধিকাংশ শিক্ষক। পাঠদান ও গ্রহণের উদ্দেশ্যেও পরিবর্তন এসেছে। ভালো মানুষ নয় ভালো ফল চাই। এই প্রতিযোগিতায় অভিভাবকরাও যোগ দিয়েছেন। যে ভাবেই হোক ভালো ফল আনতেই হবে। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে। যোগ হয়ে সমাজের নেতিবাচক নানা অনুসঙ্গ।  একটা প্রাণহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বাড়ছে সনদ সর্বস্ব আলোহীন সমাজ। এ প্রজন্ম বইতে পড়েছে- ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’। যার কোনো একটি শব্দের অর্থ শিক্ষার্থীদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে কিনা আমার জানা নেই।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট