চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও আত্মত্যাগের চৈতন্য

প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী 

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৩:৫২ অপরাহ্ণ

এটি সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ধরিত্রীর ক্ষুদ্রায়তনের জনঅধ্যুষিত লাল-সবুজ পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক প্রাণ বিসর্জন ও অপরিসীম আত্মত্যাগের অতুলনীয় ধূসর দৃশ্যপটে উদ্ভাসিত বাংলাদেশের পবিত্র মানচিত্র। বরেণ্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার জনাব আবুল মনসুর আহমদের মতে, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৪০-এ লাহোরে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন; বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেশবাসীকে সফল গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন। বিস্ময়কর পদচারণায় বিশ্ব ইতিহাসে প্রণীত হয়েছে বাঙালির সাহসীকতা-নির্ভীকতা ও যুদ্ধজয়ের অবিনশ্বর গৌরবগাথার অনবদ্য অধ্যায়। অব্যাহত ঘটনা-পরম্পরা, সংঘাত-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত যুগান্তকারী মাইলফলকের মতো সুস্পষ্ট বাঙালির সমাজ ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। অমূল্য এই স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিশাল ও বিস্তৃত অতীতের সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন, নিপীড়ন-নির্যাতন-নিষ্পেষণ-বঞ্চনার করুণ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যায়ন।

ধারাবাহিকতায় ছিল সিপাহী বিপ্লব, স্বরাজ ও খেলাফত আন্দোলন, কৃষক-প্রজা আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা অন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ছয় দফা ও ৬৯’র গণআন্দোলন, ৭০ এর জাতীয় নির্বাচন এবং সর্বোপরি রক্তক্ষচিত ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ।

বাঙালি মাত্রই জানেন যে, ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকই পাকিস্তান আন্দোলন খ্যাত লাহোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম বাংলার ভোটাররা প্রায় ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতে মুসলিম প্রাধান্য প্রদেশ সমূহের মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। তথাপি পাকিস্তানির ২৫ বছরের শাসনামলে এই পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির নির্মম, আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী ঔপনিবেশিক দুর্বব্যবহার সম্পর্কে সকলেই সম্যক অবগত। সাবেক পাকিস্তান মূলত রাষ্ট্রের সমগ্র নাগরিক সমর্থিত কোন রাষ্ট্র ছিল না। এই তথাকথিত রাষ্ট্রে ২৩ বছরে কোন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সামরিক- বেসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটচালে শাসনতান্ত্রিক একটি সংবিধানও রচিত হয়নি। নয় বছরের চেষ্টায় যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল; একদিনের সামরিক আঘাতে চরম চক্রান্ত ও নৈরাজ্যের অপকৌশলে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়।

ক্রিপস্ কমিশন মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে খাজা নাজিম উদ্দিন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ঈসমাইল খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট এ্যাকশন কর্মসূচির ফলস্বরূপ কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার যে সূত্রপাত হয়; সোহরাওয়ার্দীর সাথে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থেকে বঙ্গবন্ধু এই উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। কংগ্রেস প্রস্তাবিত বঙ্গদেশকে পূর্ব-পশ্চিম হিসেবে ভাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে বিল উত্থাপিত হয়েছিল, তার বিপক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, ও শরৎচন্দ্র বসু এই তিন নেতা অখন্ড বাংলাদেশ দাবি করেন। অখন্ড বাংলাদেশের সমর্থনে নেতৃত্বদানকারী সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং তাঁর বিপরীতে বঙ্গদেশ বিভক্তির সমর্থক খাজা নাজিম উদ্দিনের মধ্যে নেতৃত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও কতিপয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ছাড়া সেই সময় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি আর কারও সমর্থন তেমন সুস্পষ্ট ছিল না।

পরবর্তীতে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব-পাকিস্তান প্রদেশ সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সেই সাংগঠনিক দক্ষতা আরো বেগবান হয়। মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় তিনি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আরো পরে নিজস্ব আদর্শ ও ভূমিকার ভিত্তিতে ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতায় অভিষিক্ত হয়। তাছাড়া ৫৪’র নির্বাচনে বিজিত নেতৃত্বকে বারবার বাতিল করে দেওয়ার করাচি ষড়যন্ত্র, ৫৮’র সামরিক শাসন, ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং ভূমিকা ও ফলশ্রুতিতে জেল-জুলুম অত্যাচার বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত ও কিংবদন্তি জনপ্রিয় নেতার আসনে মর্যাদাসীন করা হয়।

পর্যায়ক্রমে ৬৬ সালে চট্টগ্রামের জনসভার মাধ্যমে ছয় দফা প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার কর্তৃক বহু সংখ্যক মামলা দায়েরের মাধ্যমে জেল-জুলুম গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুকে ১ নং আসামি করে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এরই প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র বাংলা। পূর্ব বাংলার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সংঘটিত আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ১১ দফা ঘোষণা করা হয়। এই ১১ দফাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠা স্বাধিকার আন্দোলন গণআন্দোলন থেকে জন্ম নেয় গণঅভ্যুত্থানে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের চরমভাবে দন্ডিত করার যে নীল নক্শা প্রণীত হচ্ছিল তাঁর বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মৌলানা ভাসানীর জনসভায় সংগ্রামী জনতার উচ্চারণ ধ্বনিত হল ’জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। তার পরবর্তী ইতিহাস’ ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ যার ফলে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার কর্ণধার তথা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সকল পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এই বিজয়কে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করে। এর প্রেক্ষিতে ৭১’র ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম এখনও বহুলাংশে অসম্পূর্ণ। প্রাসঙ্গিকতায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য তনয়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন প্রাক্কালে দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয় বা উন্নয়নশীল বিশ্বে পরিণত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। বৈশ্বিক করোনা অতিমারির দুঃসময়েও বিরল এই প্রাপ্তির মহোৎসবের মহামিলনে ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে আপামর দেশ ও বিশ্ববাসীর অংশগ্রহণ নবতর বিস্ময়ে উজ্জীবিত।

১০ এপ্রিল ১৯৭২ বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এই প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরঙ্গনা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙালিরা, সাবেক ইপিআর পুলিশ আনসার মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ স্বশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিবনগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে স্বীকৃতি ও সমর্থিত একই সাথে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে। স্বাধীনতার সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সাথেও এই গণপরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে। এক্ষণে এই গণপরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্যে একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।’ এই প্রস্তাবের পক্ষে পরিষদের সকল সদস্যগণ সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করলে সম্মানিত স্পীকার এই প্রস্তাব গৃহীত হলো বলে ঘোষণা দেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে কবি জীবনানন্দ দাশের সেই অমর কবিতায় উপস্থাপিত পাদপীঠে। যথাযোগ্য মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত কবিতার পংক্তিগুলো গ্রন্থিত হয়েছিল : ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়’ বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়; আধুনিক মানব সভ্যতার পাঠোদ্ধারে চিরন্তন-চিরঞ্জীব-মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনাবর্তের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবেই সুপ্রতিষ্ঠিত। আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকল শহীদ সদস্য, জাতীয় চার নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের স্মৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। দুই লক্ষ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগ, আহত-পঙ্গু-ইতিমধ্যে নিহত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেই নিবন্ধের ইতি টানছি।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট