চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বেঁচে যাবেন আপনি, বাঁচবে পরিবারও

সার্জেন্ট মো. আনোয়ার হোসেন রাজু

১৩ জুন, ২০২০ | ৩:৩৮ অপরাহ্ণ

২০০১ সাল। জনৈক ছাত্র তার মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে শিক্ষকের কাছে জিপিএ ৩.৫০ কেমন রেজাল্ট জানতে চেয়েছিল। স্যার নিজের ডানহাতের তর্জনী মোবারক মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলেন “৩.৫ ! ভাল, ভাল বেটা ভাল”।

বর্তমান যুগে হাজার হাজার জিপিএ ফাইভের ভিড়ে ঘটনাটা যাদের কাছে হাস্যকর বা অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি ২০০১ সালেই প্রথম বাংলাদেশে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ শুরু হয়। সারা বাংলাদেশে মাত্র ৭৬ জন ছাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছিল। বর্তমানে ঘরে বাইরে বনে জঙ্গলে যেখানে সেখানে জিপিএ-৫ এর ছড়াছড়ি অথচ সেই প্রথম বছরে কয়েকটি বোর্ডেই কোন জিপিএ-৫ ছিলনা। শিক্ষকদের প্রতি শতভাগ সম্মান রেখেই বলছি অনেক স্বনামধন্য ও নামিদামি স্যারেরাও তার ছাত্রকে জিপিএ’র ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে দিতে পারেনি।
এটা অজ্ঞতা নয়, নতুন কিছু একটা চালু হলে প্রথম প্রথম বুঝে উঠতে একটু সময় লেগে যায় এটাই স্বাভাবিক। যেমনটা ঘটেছে বিশ্বব্যাপী করোনার ক্ষেত্রেও। যখন চায়না থেকে ইতালি, গ্রীসে লাশের মিছিল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী সেলফ কোয়ারেন্টাইনে, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী করোনা পজেটিভ হয়ে হাসপাতালে তখনও খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিষয়টা নিয়ে খুব হাস্য-তামাশায় মগ্ন ছিলেন। হয়তো সাংবাদিকরা করোনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনিও ডানহাতের তর্জনী মোবারক মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে উত্তর দিয়েছিলেন “চায়না ভাইরাস! ভাল বেটা ভাল।” আজ আমেরিকাকে তার চরম খেশারত দিতে হচ্ছে। করোনার লাশের সংখ্যায় আজ আমেরিকা প্রথম স্থান অধিকারী।

ভাই আমেরিকা বলে কথা। তাদের মত দেশ কিছুই করতে পারে নাই আমরা আর কি করবো? ব্যস! আমার দেশের চা-দোকানের বুদ্ধিজীবী কাকু পেয়ে গেলেন উনার টপিকস। সাথে বাঙ্গলার আপামর জনতার সাপোর্ট। আমলা, কামলা, মজুর, চামার, মুচার(?), মন্ত্রী, জ্ঞানী, মূর্খ, আবাল সহ দেশের প্রায় সবাই এই এক জায়গায় মি. ট্রাম্পের সাথে একমত। চায়না করোনা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমরা পান খাই, আমরা ডিজেল খাই, আমরা সাপ খাই না, শিয়াল-কুত্তা খাইনা। বাহ! অতীব চমৎকার, অতীব চমৎকার। এই করোনার প্রভাবে বাঙ্গালীর খাদ্যাভ্যাস আজ বিশ্বব্যাপী অবমুক্ত। এখানেই ক্ষান্ত হলে প্রিয় সাংবাদিক ভাইদের দোষ দিয়ে শেষ করা যেত। আপনারাও ভাই কার কার সামনে মাউথপিস ধরেন। কিন্তু না, আমাদের আরো অনেক কিছু দেখার আছে, দেখানোর আছে। আমরা দেশের সেরা সেরা আসনে বসে গুরু ট্রাম্পের সুরে গান গাইতে লাগলাম। ৩০/৪০ জনের দল নিয়া করোনার সতর্কতার বয়ান দিতে শুরু করলাম। কে বেশি শক্তিশালী তা বুঝাতে শুরু করলাম। তাপমাত্রায় করোনা কি করতে পারে আর কি পারেনা, নামাজির কেন করোনা হবে না সব সব দেখলাম আমরা আমাদের আপামর জনতার কাছ থেকে। এমনকি আমাদের এক মুরুব্বীতো হার্টখুলে হেক্সিসল দিয়ে ওয়াশ করে আবার যথাস্থানে পূনসংযোজনের মত থেরাপিও দিতে বলে বসলেন।

আমি এসবকেও অজ্ঞতা বলতে রাজি নই। বরং করোনার মত একদমই নতুন ব্যতিক্রম একটা ভাইরাসকে বুঝে না উঠতে পারাটাকেই কারন বলে আখ্যা দিতে চাই। যদিও আম পাবলিকের চাইতে আমাদের দায়িত্বশীলদের আরো আগেই আরও বেশি সংযত হওয়া উচিত ছিল। কিছু কিছু দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব জ্ঞান ও লাগামহীন কথা বার্তায় প্রায় শত ভাগ বুদ্ধিজীবীর এই দেশতো পুরাই বেকায়দা। এবার আসা যাক এই করোনা যুদ্ধের সামনের সারির যোদ্ধাদের কথায়। অনেকের মধ্যেই পুলিশ, ডাক্তার আর সাংবাদিক তাদের কথা না বললেই নয়।

সেই উহানের মহামারী থেকে শুরু করে গুরু মি. ট্রাম্প অথবা চাচার হার্ট দ্বারা হেক্সিসল ওয়াশ যত কিছুই হোক না কেন এই তিন শ্রেণীকে কিন্তু ফিল্ড ওয়ার্ক করতেই হয়েছে। তাই দেশের এই মহা সংকটকালে এরাই সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে গেল। স্যরি, এখনতো আর ঝুঁকিতেই সীমাবদ্ধ নেই বলতে হচ্ছে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত।

বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী। সরকারের যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এদেরকেই থাকতে হচ্ছে সবার আগে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে একদম সাধারন মানুষের সাথে।

তাই যে কোন সরকারি সিদ্ধান্তে দ্রুত মাঠে নেমে পড়তে হয় এই বাহিনীটিকে। মুখে মাস্ক আর গায়ে পিপিই আছে কিনা বা কেউ দিবে কিনা এসব নিয়ে ভাবার সময় তখন তাদের থাকেনা। তাইতো কিছু ডাক্তার যখন পিপিই না পাওয়ার অযুহাতে চিকিত্সা সেবা স্থগিত রেখে সরকারের সাথে দর কষাকষিতে ব্যস্ত তখনও রাস্তায় শতশত পুলিশ লাখ লাখ মানুষকে ঘরে থাকার উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল কোন রকম মাস্ক বা ব্যক্তিগত করোনা প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ছাড়াই। বৃষ্টিতে সুরক্ষার জন্য সরকারী বরাদ্ধকৃত রেইনকোট পরেই মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাজার খাবার, রোগীকে ঔষধ পৌঁছে দিয়েছে এমনকি করোনার ভয়ে ফেলে যাওয়া লাশটিকে কবরে দাফন পর্যন্ত করেছেন এই পুলিশ সদস্যরা। অথচ তখনও ঘরে ঘরে করোনা পজেটিভ রুগী আত্মগোপনে। মিথ্যা তথ্যের কারনে এদের মধ্যে অনেকেরই করোনা পজেটিভ যা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের মধ্যে সংক্রমিত করে নিয়েছে এই যোদ্ধারা।
এটাকেওতো অজ্ঞতা বলা যাচ্ছে না। প্রথম প্রথম নতুন কিছু বুঝে উঠতে সময়ের প্রয়োজন। নতুন আকারে সংক্রমন, হোম কোয়ারেন্টাইন, মাস্ক, হেন্ড ওয়াস ইত্যাদিতে তো আমরা অভ্যস্ত নই। কিন্তু এই অজ্ঞতা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে পৌঁছাতে পারে তা একমাত্র আল্লাহ’ই ভাল জানেন।

হ্যাঁ, এসেছে। এখন আস্তে আস্তে সব কিছুই পাচ্ছি আমরা। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাবস গায়ে পিপিই বা হাত ধোঁয়ার সেনিটাইজার সব সবই আছে আমাদের। তবে যে ক্ষতি হয়ে গেছে বা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে তা যেন আর না হয়। আর যেন একজন মানুষও আক্রান্ত না হয়। তাই প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ সব খুলে দিক আপনি শুধু নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন। বেঁচে যাবেন আপনি বেঁচে যাবে আপনার পরিবার আর বেঁচে যাবে এই দেশ। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেন না। আপনি বাঁচুন আমাদেরকে বাঁচতে দিন।

লেখকঃ ট্রাফিক বন্দর, সিএমপি,চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট