চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা

কামাল আহমেদ

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৮:২৩ অপরাহ্ণ

বাঙালি জাতি হিসেবে কয়েক হাজার বছরের পরিক্রমায় বহুজাতিক সংমিশ্রণের স্রোতধারায় প্রতিষ্ঠিত পৃথক একটি জাতিসত্তা। বহুভাষী বহুরূপের বহুধারার ভেতর থেকে পাওয়া আলাদা একটি ভাষাÑবাংলাভাষা আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের কথা বলে। পৃথিবীর একমাত্র ভাষা-বাংলাভাষা, যে ভাষার সন্তানেরা ভাষার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছে। এখানেই তারা থেমে থাকেন নি, আদায় করে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি। যে কারণে এই ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণবিসর্জনের দিনটি বহুকাল ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসলেও সেদিনটি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এই অদম্য সাহসী বীর বাঙালির মায়েরভাষার এই আন্তর্জাতিকতার নেপথ্যেও রয়েছে অনেক কথা। এই ভাষাকে ঘিরেই প্রথম বঙ্গীয় সমাজে পৃথক বাংলা বা বাংলাদেশ ধারণার ও আত্ম-অন্বেষণের বিকাশ ঘটানোর মধ্যদিয়ে স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্ন রচিত হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানে জন্ম নেয়া পৃথক দু’টি দেশÑ ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমরা পাকিস্তানের অংশ হয়েও আলাদা ভূখ-, আলাদা ভাষার পূর্ব পাকিস্তানবাসীর পাকিস্তান জীবন শুরু থেকেই সুখকর হয়নি। ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ভাষা-বিক্ষোভ সূচনা হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চরম প্রকাশ ঘটে।
ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে সরকারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের উপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্রযুবা হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানেরর অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেবল ভাষার জন্য আন্দোলন করে এরূপ জীবন উৎসর্গ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দু’বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা দিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য ১৮৮টি দেশে একযোগে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জাতিসংঘে একটি ওয়েবসাইটও খোলা হয়। এই ওয়েবসাইটে আজ শোভা পাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যময় শহীদ মিনারের চিত্র। একই সাথে সেখানে এই দিবসের প্রেক্ষাপটে একটি ভূমিকাও উল্লেখিত আছে। ভূমিকাটি নিম্নরূপ:
“মাতৃভাষার জাগরণে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বের স্থানান্তরিকরণ লক্ষ্যমাত্রা রক্ষায় এবং জ্ঞানের সকল উৎস এবং প্রকাশের সকল রূপ এর জাগরণে উন্নয়নের সকল শক্তিকে সংঘবদ্ধ করতে হবে। এগুলোই সেই সুতো যা মানবতার কারুকার্য বুনবে।” ( অনুবাদ : মামুন ম. আজিজ)।

তবে, দুঃখের বিষয়, যে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যময় আন্দোলনের দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়েছে সেই ভাষাতেই ওয়েবসাইটটি পড়া যায় না, যদিও ইংরেজি, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিস, আরবি, চাইনিজ ইত্যাদি ভাষায় ওয়েবসাইটটি পড়া যায়।
২০০৯ সালের ১৬ মে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এর সদস্য রাষ্ট্র সমূহের প্রতি ‘বিশ্বের সকল মানুষের ব্যবহৃত ভাষাগুলোর সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের’ প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সাধারণ সভায় বহুমাত্রিক ভাষার চর্চা ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতায়ন এর মাধ্যমে ডাইভারসিটিতে একতা বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার কথা বলাহয়।
সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম এর মতো কোনো বাংলাদেশির আত্মচেতনা থেকে কাজ করার ফলস্বরূপ জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের বক্তব্যটি প্রিয় বাংলাভাষায় পড়া যাবে।
সবচেয়ে বড়কথা, আমাদের ‘শহীদ দিবস’Ñ২১ ফেব্রুয়ারি যে আজ বিশ্বজুড়ে জানাজানি হলো, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’Ñমর্যাদা লাভ করলো, তাও আমাদের বিশাল অর্জন। আমরা আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, প্রিয়ভাষা, বাংলা আমার অহংকার।

লেখক হ কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট