চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

প্রাচীনকালের নিদর্শন

ঠাকুরদিঘী খননের আলৌকিক কাহিনী

এম.এম. আহমদ মনির হ লোহাগাড়া

১০ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১০ পূর্বাহ্ণ

লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সর্বশেষ উত্তর সীমানায় ও পাশের উপজেলা সাতকানিয়া দক্ষিণ সীমানায় রয়েছে বহুল আলোচিত ঠাকুরদিঘী। দুই উপজেলার বহুল আলোচিত অতিপ্রাচীন নিদর্শন এ ঠাকুরদিঘী। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে দিঘীটি সাতকানিয়া উপজেলার করইয়া নগর ও লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়ন সংলগ্ন।

দিঘীর পূর্বপাশ দিয়ে চলে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়ক। দিঘীকে কেন্দ্র করে পার্শ্বে গড়ে উঠেছে ঠাকুরদিঘী বাজার। ফলে স্থানটিতে দোকানপাট গড়ে উঠায় সকলের কাছে স্থানটির গুরুত্বও বৃদ্ধি পায় সকলের কাছে। কিন্তু বহুল আলোচিত দিঘীটি অযত্ন-অবহেলায় ও সংস্কারের অভাবে অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। তবে, নাম সর্বস্ব আজো ঠিকে আছে প্রাচীনকালের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে।

দিঘীর তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় ৫শ বছর পূর্বে এলাকায় তেমন জনবসতি ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করত লোকজন। যাতায়াত ব্যবস্থাও তেমন ছিল না। ঝোপ-জঙ্গল, পাহাড়-টিলাবেষ্টিত জনবসতি এলাকা ছিল বিপদসঙ্কুল। প্রকৃতির কাছে মানুষ ছিল অসহায়। নিরক্ষরতার অভিশাপে তারা ছিল ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। রোগ-ব্যাধিতে ব্যবহার করতে লতা-পাতার ঔষধ। কিন্তু মানুষ ছিল সহজ-সরল প্রকৃতির। শিক্ষা জ্ঞানের অভাব থাকলেও তাদের মধ্যে ছিল সাম্য-মৈত্রির অপূর্ব মিলবন্ধন। নিজস্ব স্বকীয়তায় সামাজিকতার বুনিয়াদ গড়ে তুলে বসবাস করতে থাকেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারা বসবাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ওই সময় সবচেয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হন পানীয় জলের। এ সমস্যায় ওই সময় পুরো এলাকার মানুষ ভোগান্তির শিকার হন। সমস্যা সমাধানে সলা-পরামর্শ শুরু করেন লোকজন। ভিড় জমান এলাকার সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারে। ওইসময় ঠাকুর পরিবার ছিল বিত্তবান। তারা ছিলেন মহৎ ও উদার মন-মানসিকতা সম্পন্ন। প্রথমে যাতায়াত ব্যবস্থা সংস্কার কাজে মন দেন। পরে বসবাসযোগ্য সুন্দর আবাসস্থল গড়ে তুলেন। এরপর উদ্যোগ নেন পানীয় জলের সমস্যা দূরীকরণের। সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারের ৩ সহোদর যথাক্রমে ঠাকুর চান, মালী চান, আলী চান প্রমুখ ব্যক্তিগণ ৭ দোন, ৭ কানি, ৭ গন্ডা, ৭ কড়া তথা প্রায় ২ হাজার ৮শ শতক আয়তনবিশিষ্ট বৃহদাকারের দিঘি খনন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মাটি কাটা শ্রমিকের স্বল্পতায় দিঘি খনন কাজ মন্থর গতিতে চলছিল। ওই সময় খনন কাজে ব্যবহার করার মতো কোন যন্ত্রদানব ছিল না।

স্থানীয় প্রবীণ লোকেরা জানান, তারা তাদের পূর্বের প্রবীণদের কাছে শুনেছেন দিঘি খননকাজে মাটি কাটা শ্রমিকদের সাথে জ্বীন ও দৈত্যরা খননকাজে রাতে-দিনে অংশগ্রহণ করে। অন্যথায় এ বিশাল দিঘি যন্ত্রদানব ছাড়া ওই সময় মানুষের পক্ষে খনন করা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। দীর্ঘ সময় পর খনন কাজ শেষ হয়। পানিতে ভরে যায় দিঘি। চারিদিকে আনন্দ-উল্লাস বইতে থাকে। ঠাকুর বাড়ির প্রতি জনগণের অকুন্ঠ ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। সর্বত্র বাজতে থাকে ঠাকুর পরিবারের জয়ধ্বনি। জনশ্রুত আছে, দিঘি খনন কাজ শেষ হওয়ার পর কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে।

তথ্যসূত্রে প্রকাশ, স্বপ্নের মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের জনৈক ব্যক্তি অবগত হন যে, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের ব্যবহার্য বড়-ছোট ডেকচি, পেয়ালা, বাসনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র পেতে ভক্তি সহকারে দিঘীতে কিছু পান-সুপারি ফেলে দিলে পরদিন সকালে জিনিসপত্র নিয়ে একটি সোনার নৌকা পানির উপর ভেসে উঠত। পরবর্তীতে অনুষ্ঠান শেষে পুনরায় ওইসব জিনিসপত্র দিঘীর পাড়ে এনে রাখলে নৌকা ভেসে উঠে ওইসব জিনিসপত্র নিয়ে ডুবে যেত। যে কোন এক সময় অনুষ্ঠান শেষে সব জিনিস ফেরত না দেয়ায় পরবর্তীতে লোকজন ওই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া দিঘীর এক একটি মাছের ওজন তৎকালীন সময়ে ২০/৩০ কেজি হত বলে উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, এ বিশাল দিঘিটি বর্তমানে অনেকটা ভরাট অবস্থায় পড়ে আছে। নাম সর্বস্ব অতীতের এক নীরব স্বাক্ষী বহুল পরিচিত এ ঠাকুরদিঘি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট