চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

আলুটিলা গুহায় গমন সে এক রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চার

মো. নিজাম উদ্দিন লাভলু হ রামগড়

৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

গা ছমছম শিহরণ জাগানিয়া নিস্তব্ধ জমকালো অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহা। শীতল স্বচ্চ ক্ষীণ জলধারায় পিচ্ছিল আঁকাবাঁকা পাথুরে এ গুহা পাড়ি দেয়া সেই এক অন্যরকম ভয়-আতঙ্ক-রুদ্ধশ্বাস এডভেঞ্চার। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট সুউচ্চ আলুটিলা পাহাড়ে দীর্ঘাকারের এই রহস্যময় প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বা গুহার অবস্থান। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রধান সড়কে শহরের প্রবেশ পথেই আলুটিলা পর্যটন স্পট। গুহায় গমন ও বের হওয়ার জন্য ২৬৬ ধাপের আলাদা আলাদা দুটি সিঁড়িপথ রয়েছে। সিঁড়িপথ দুটিও আঁকাবাঁকা ও মজবুত। উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেকখানি ইট বিছানো ঢালু রাস্তা হেঁটে এগিয়ে এসে ২৬৬ ধাপের এ বিশাল পাকা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার পরই দেখা মিলবে এ রহস্যময় গুহার। পাহাড়ের চূড়া হতে গুহায় গমনের সিঁড়িরমুখে রয়েছে বিশ্রাম শেড। পাহাড় থেকে নেমে এসে এবং গুহা থেকে উঠে এসে এখানে ক্ষাণিক বিশ্রাম নিলে ক্লান্তি কিছুটা দূর হয়। কোমল পানীয়, কলা ও বিস্কুট ইত্যাদি হালকা নাস্তাও কিনতে পাওয়া যায় বিশ্রাম শেডে। একসময় আলুটিলার বটমূলের এক চিমটে মাটি মুখে দিয়ে গুহায় গমনের একটা কুসংস্কার চালু ছিল। বলা হত, এ মাটি মুখে না দিয়ে গুহায় গমন করলে ফিরে আসা যাবে না। এখন অবশ্য এটি আর মানে না কেউ।

সুউচ্চ শিলা পাথরের পাহাড় ভেদ করে বিশালায়তনের এ সুড়ঙ্গ বা গুহাটি প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট। জমকালো অন্ধকারময় প্রায় ২৮২ ফুট দীর্ঘ এ গুহার একপ্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে অপরপ্রান্ত দিয়ে বের হওয়া যায়। এ সুড়ঙ্গের ভিতরে কয়েকটি শাখা গুহা আছে। তবে এগুলো আবদ্ধ। আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ পথটির কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু। অধিকাংশ পথ পাড়ি দিতে হয় কুঁজো হয়ে।

মশাল, টর্চ কিংবা সার্চলাইটের আলোয় পাড়ি দিতে হয় এ গুহা। গুহার প্রবেশমুখের ব্যাস ১৮ ফুটের মতো। সুরঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই হিমেল হাওয়ায় শরীর, মন জুড়িয়ে যায়। সুরঙ্গে বহমান ঝরণার ক্ষীণ জলধারাও শীতল ও স্বচ্চ। গুহার পাথুরে দেয়াল মসৃণ হওয়ায় পা পিছলে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়। হাতে একটি শক্ত লাঠি থাকলে পথ চলতে সুবিধা হয়। জমকালো অন্ধকার, নিস্তব্ধ হিম শীতল গা ছমছম শিহরিত এ রহস্যময় সুড়ঙ্গ অতিক্রম করতে সময় লাগে শ্বাসরুদ্ধকর ১৫ মিনিট। এ অভিযান অন্যরকম রোমাঞ্চকরও। তবে দুর্বলচিত্তের কেউ এ সুড়ঙ্গে গমন না করাই উচিত। গুহার প্রবেশমুখ ভয় জাগানিয়া কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন আর শেষপ্রান্তে আলোকবিচ্ছুরণ। বুক ধরপর রুদ্ধশ্বাস পথ পাড়ি দিয়ে শেষপ্রান্তের এ আলোকবিচ্ছুরণ দেখামাত্রই আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হন সবাই। ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা গুহাটিকে তাদের ভাষায় ‘মাতাই হাকর,’ অর্থাৎ দেবতার গুহা নামে আখ্যায়িত করেন। তাদের বিশ্বাস, শিলা পাথরের বিশাল পাহাড়ের গায়ে এ সুড়ঙ্গ বা গুহাটি কোন দেবতারই আবাসস্থল। এ বিশ্বাস থেকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ এ গুহায় মাঝেমধ্যে পূজোও দেয়।

মানুষের আনাগোনার আগে বাঁদুড়ের আবাসস্থল ছিল গুহাটি। বিশেষ করে ৯০ এর দশকের পর এ সুড়ঙ্গে পর্যটকদের পদচারণা শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যে গুহাটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে সুড়ঙ্গে গমন ও বের হওয়ার জন্য ইটের রাস্তা ও পাকা সিঁড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করা হয়। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যকোন দেশে এমন দীর্ঘ প্রাকৃতিক গুহা আছে কি না সন্দেহ। দেশের বিভিন্ন স্থান হতে প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। রহস্যময় গুহাটি এখন সারাদেশের পর্যটকদের কাছে অতি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা দেশের যেকোন স্থান থেকেই সহজেই আসা যায় আলুটিলায়। বিশালায়তনের সুউচ্চ এ পাহাড়ের বুক চিড়ে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে চলে যাওয়া মহাসড়কের পাশেই আলুটিলা পর্যটন স্পট। শতবর্ষী বটবৃক্ষের ছায়াতলে এ পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশদ্বার। এখানে কাউন্টারে জনপ্রতি ২০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে ঢুকতে হয়। রহস্যময় গুহায় গমনের জন্য ওই কাউন্টারেই কিনতে পাওয়া যায় বাঁশের তৈরি মশাল ও দিয়াশলাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট