চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

লাঙলে হালচাষ এখন শুধুই স্মৃতি থেমে গেছে ‘হেরা তিতি ব’

মো. দেলোয়ার হোসেন

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

কালের বিবর্তনে পালাক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার সেই সোনালি অতীত। ঐতিহ্য ও নানা আবিষ্কারের ইতিহাস। এরই একটি হচ্ছে গরুটানা হালচাষ পদ্ধতি। ‘হেরা তিতি ব’ তিনটি কথার মাইনি ক’। এটি একটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রবাদ বাক্য। এর পেছনে দেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস জড়িত। হালের গরু আর লাঙ্গল-জোয়াল দিয়ে জমির চাষ করার ক্ষেত্রে এর প্রবাদ জানা অপরিহার্য। হেরা বললে গরু হাঁটে, ডানে-বামে ঘোরার জন্য বলতে হয় তিতি, আর ব বললে গরু থেমে যায়।

রূপ, রং আর ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। শস্যের শ্যামলতা, ভাটিয়ালী গানের সুর, রাখালের বাঁশি, কৃষাণের উদার জমি, কৃষাণীর ধান বানার উল্লাস, ছয় রূপের ৬টি ঋতু সব মিলিয়ে এ যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে রং তুলিতে আঁকা স্বপ্নের দেশ। এদেশে সন্ধ্যা-সকালে ডাহুক, দোয়েল, কোয়েলের ডাকে ঘুম ভাঙে। প্রকৃতির পালাবদলে আসে ৬টি ঋতু। ঋতুচক্রের ঘূর্ণায়মান রূপকালে আসে আমন, আউশ ও বোরো ধানের চাষাবাদের সময়।

মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে জমি চাষে কাঠের তৈরি চাঁদ আকৃতির লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গল। সেইসাথে পশু ব্যবহারের মাধ্যমে ফলানো হতো সোনালি ফসল। আর এটাই ছিল এখানকার একমাত্র চাষাবাদের পদ্ধতি। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার নিরন্তর প্রচেষ্টায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের যুগে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপক বিস্তার ও ব্যবহার, উন্নত কৃষি পদ্ধতির মোকাবেলায় টিকে থাকতে পারছে না সেকালের সেই লাঙ্গলের জমি চাষ পদ্ধতি। প্রত্যন্ত পল্লীতে এখন আর দেখা যায় না গরু টানা লাঙ্গলের হাল। অতীত যেন হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের গহ্বরে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আদিম মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে শিকারের নেশায় ঘুরে বেড়াত বন-জঙ্গলে। একসময় তারা দেখতে পেল বন-জঙ্গলে বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষধিসহ নানা প্রজাতির বীজ মাটিতে পড়ে ও পশু-পাখি বিষ্ঠায় থাকা বীজ হতে অনুরূপ আরেকটি গাছ জন্ম নেয়। এতে ফুল-ফলে ভরে ওঠে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে। তাতেও উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা অনুভব করল বন-জঙ্গলে ঘোরাফেরা না করে এক জায়গায় সংঘবদ্ধভাবে স্থায়ী বসবাসের। বিভিন্ন খাদ্যশস্যের বীজ সংগ্রহ করে নেয়। নিজেদের তৈরি শক্ত ধাতব বস্তুর মাধ্যমে মাটি খুঁড়ে ফসল ফলাতে শিখল।

একপর্যায়ে কাঠের তৈরি চাঁদ আকৃতির লাঙ্গল ও তাতেই পশু ব্যবহারের মাধ্যমে জমি চাষ করে একধাপ এগিয়ে নব সভ্যতার যুগে প্রবেশ করল। তারই ধারাবাহিকতায় সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত এ চাষ পদ্ধতি দৃশ্যময় চলে আসতে থাকে। হালচাষীদের জীবন চিত্র অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে আমাদের দেশ থেকে সেই ঐতিহ্য হালচাষ পদ্ধতি হারিয়ে গেছে। আমাদের দেশের ৯০ এর দশক পর্যন্ত এ হালচাষ পদ্ধতি ছিল কৃষি উৎপাদনের একমাত্র উপায়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কারণে সারাদেশের ন্যায় চন্দনাইশ থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল ও হালের বলদ দ্বারা জমি চাষ।

বাংলাদেশে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বর্তমান মাথাপিছু জমি ০.০৬ হেক্টর। পঞ্চাশ বছর আগে ছিল ০.১৪ হেক্টর। ক্রমশঃ জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। চাষে ক্রমান্বয়ে জমি কমে যাচ্ছে ১ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১.৪২ শতাংশ মানুষ বাড়ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর ২২ লক্ষ মানুষ বেড়েই চলেছে। যাদের জন্য প্রয়োজন ৪ লক্ষ টন খাদ্য। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষাবাদ করা হচ্ছে। উপজেলার সবকটি ইউনিয়নেই সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষকেরা এখন জমি চাষে দ্রুত চাষযোগ্য ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার ব্যবহারের কারণে তাদের পরিশ্রম, খরচ কম ও সময় কমে গেলেও ফলনের গুণগতমান বাড়েনি। আগের তুলনায় জমিতে উৎপাদিত ফসলের স্বাদ অনেক কমে গেছে। তবে এ নিয়ে কৃষকদের কোন আক্ষেপ নেই। চন্দনাইশ পৌর এলাকার প্রবীণ কৃষক মুন্সি মিয়া জানান, লাঙ্গল ব্যবহারে চাষাবাদের জমি সর্বোচ্চ উর্বরতা শক্তি ব্যবহৃত হতো। ট্রাক্টর কিংবা পাওয়ার টিলারের দ্বারা জমি চাষ দিলে জমি তুলনামূলকভাবে কম উর্বরতা শক্তি পায়। জমিতে অধিক রাসায়নিক সারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক গাজী সালাহ উদ্দিন বলেন, গরু আর লাঙ্গল-জোয়াল দিয়ে জমি চাষ কৃষি সভ্যতার শুরু থেকে। কৃষিকাজ এবং জমি চাষ এখনো বহাল রয়েছে। তবে কালের বিবর্তনে লাঙ্গলের দাপটে হালের গরু আর লাঙ্গল-জোয়ালের ব্যবহার বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। মানুষের গোয়ালভরা গরু এখন আর চোখে পড়ে না। ‘হেরা তিতি ব’ এর আওয়াজ করে গরু আর লাঙ্গল-জোয়াল দিয়ে জমি চাষের দৃশ্য এখন নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রাণী সরকার জানান, কম সময়ে জমিতে চাষাবাদ ও অধিকতর ফলন উৎপাদনের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। তবে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতির ধারাবাহিকতায় অধিকতর পুষ্টিগুণসম্পন্ন শস্য উৎপাদন সম্ভব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট