চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বড়হাতিয়ায় বিলুপ্তপ্রায় লোকজ সংস্কৃতি

এম এম আহমদ মনির হ লোহাগাড়া

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

লোহাগাড়ায় গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি দিনদিন বিলুপ্তির পথে। একদা গ্রামীণ জনপদ ছিল লোকজ সংস্কৃতি ও গ্রাম্য মেলার আনন্দঘন পরিবেশে সমৃদ্ধ। নবান্ন উৎসব, তুমব্রু খেলা, গরুর লড়াই-বলী খেলা, থিয়েটার ড্রামা, নাটক, নাচ-গানের আসরসহ নানা জাতের লোকজ সংস্কৃতির মিলনমেলায় গ্রামীণ পরিবেশ ছিল কর্মমুখর ও আনন্দ-সোহাগ মিশ্রিত। বিশেষ করে শরৎশান্ত হেমন্তের বাতায়নে গ্রামীণ জনপদ হতো লোকজ সংস্কৃতির গ্রাম্যমেলায় সরব ও আনন্দমুখর। এমনকি আনন্দরসে ভরা রূপকথার কাহিনী আনন্দ দিত সেকেলের মানুষের মনে। নববর্ষ বৈশাখকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো গরুর লড়াই, বলী খেলা, তুমব্রু খেলা প্রভৃতি। তৎকালীন সময়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা অবুঝ মনে ছুটে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করত মেলায়। এ ধরনের মেলায় পাওয়া যেত রকমারি পসরা। পছন্দের পণ্যসামগ্রী ক্রয় করত মেলার আনন্দ উপভোগকারী দর্শকেরা। তাই বৈশাখের গ্রাম্য মেলার অংশ হিসেবে বড়হাতিয়ার আমতলী গ্রামে অনুষ্ঠিত হতো দু’দিনব্যাপী গরুর লড়াই ও বলী খেলা। মানুষের যোগসূত্র ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এলাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান মরহুম ছিদ্দিক মিঞা সম্ভবতঃ ১৯৪৭ সালের দিকে এ গ্রাম্যমেলার গোড়াপত্তন করেন বলে জনশ্রুত। বিশেষ করে বৈশাখ মাসের মধ্যভাগে তথা এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে এ মেলা অনুষ্ঠিত হতো।

মেলার আয়োজন ছিল ব্যাপক। বহু দূর-দূরান্তের দর্শক, পণ্যসামগ্রী বিক্রেতার সমাগম ঘটত। মেলার কার্যক্রম শুরু ও শেষ হতে সময় লাগত সপ্তাহখানেক। প্রথমদিন গরুর লড়াই এবং দ্বিতীয়দিন অনুষ্ঠিত হতো বলী খেলা। বড় বড় ষাঁড় ও দূর-দূরান্তের নামী-দামি বলীরা অংশগ্রহণ করতেন। যার কারণে এ মেলা পরিচিতি লাভ করে ছিদ্দিক মিঞার গরুর লড়াই ও বলী খেলা নামে। মেলার মাঠের নিকটেই তার বাড়ি। এ বাড়ি আজো স্মৃতিবহুল। তবে, তিনি আজ আর নেই। তৎকালীন সময়ে মানুষের এ মিলনমেলা ছিল গ্রামীণ মানুষের সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দর্শকরা গরুর লড়াই ও বলী খেলা দেখত এবং মেলার আশপাশের লোক ছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আগত লোকদের অনেকেই খাবারসামগ্রী ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র ক্রয় করতেন। মৌসুমী ফল, মিষ্টিজাত দ্রব্য, বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসপত্রসহ রকমারি পণ্যসামগ্রী বেচা-কেনার ধুমধাম ছিল প্রচুর। অপরদিকে, ছিল জুয়াখেলা ও বিত্তবিনোদনমূলক জাদু খেলা প্রদর্শনী, নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ নামে এক জাতীয় বিনোদনমূলক প্রদর্শনী। যে কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতির মাঝে মেলায় অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লাগে।

একদা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্য ও গ্রামীণ সাংস্কৃতিক চেতনায় মানুষের মনে প্রকৃত চেতনার বিকাশ ঘটে। পর্যায়ক্রমে ধর্মীয় অনুভূতি ম্লান হওয়ার উপক্রম হলে এগিয়ে আসেন দ্বীনি আলোর প্রদীপ হাতে পীরে কামেল শাহ সুফি হযরত মাওলানা আবদুল জব্বার (মা. জি.আ.)। তিনি ওই সময় বায়তুশ শরফের পীর ছাহেব ছিলেন। তিনি দীপ্তিময় দ্বীনি আলোর শিখা জ্বালিয়ে আলোর পথে আনার জন্য গরুর লড়াই ও বলী খেলার নামে অপসংস্কৃতি পরিহার করে সীরাত মাহফিল (সা.) প্রচলন করার প্রস্তাব দিলে আয়োজকরা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে স্বাগত জানান পীর ছাহেব কেবলার প্রস্তাবের প্রতি। অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায় গরুর লড়াই ও বলী খেলা এবং ওই স্থানে ১৯৭৭ সালে জাবালে সীরাত মাহফিল (স.) এর গোড়াপত্তন হয়। দু’দিনব্যাপী আয়োজিত জাবালে সীরাত মাহফিল (স.) ধর্মীয় মর্যাদায় যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট