চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভুয়া ঠিকানায় বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট রোহিঙ্গাদের হাতে

কায়সার হামিদ মানিক

৫ মে, ২০১৯ | ১:২৫ পূর্বাহ্ণ

গত ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট তুমব্রু স্থল সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় কামাল উদ্দিন (৫০)। ৩ মাসের মাথায় তার ছেলে নূরুল আমিনকে (২২) ওমরা ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। ২০১৭ সালে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আসার আরো কয়েক বছর আগে সে মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়ে নেয়। ফলে পালিয়ে আশ্রয় নেয়ার পরও তাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন আসা রোহিঙ্গা নুরুল বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছে। শুধু নূরুল আমিন নয় এ ধরনের অনেক রোহিঙ্গা সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এরইমধ্যে আশ্রয়শিবির ছেড়েছে। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে। নূরুল আমিন মিয়ানমারের তুমব্রুলে গ্রামের ঢেকিবুনিয়া এলাকার কামাল উদ্দিনের ছেলে। সে মিয়ানমার থাকতেই বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয় পত্র নং ১৯৮৭১৯১৩১৫৭০৩৩৩৯০ বানিয়ে নেয়। ২০১৪ সালের ২১ মে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার তারাসাইল কুমারদোঘা ঠিকানায় দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নং ইই ০২২৪৮৯৯ করে নেয়। গত ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সে ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি দেয়। তার বাবা-মা ও পরিবারের অন্যরা এখনও উখিয়ার বালুখালী-৯ নং রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের নিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক।
উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া-১ নং ক্যাম্পের নিবন্ধিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক মরজিনা আক্তার তার স্বামী মৌলভী আবু বকর ছিদ্দিক। সে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বাকলিয়া থানার কালামিয়া বাজার এলাকার ঠিকানায় ১৯৮২১৫৯১০১৮০০০১১৩ নং বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে উদ্বাস্ত আশ্রয় শিবিরে দিব্যি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী মেগা আশ্রয় শিবিরের ২০ নং ক্যাম্পে অবস্থান করছে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবছার। সে পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ২৭৮ বাইশারী মৌজার দক্ষিণ বাইশারী এলাকার ঠিকানায় ০৩১৭৩১৯৩৭৫১৪৯ নং বাংলাদেশি এনআইডি বানিয়ে নিয়েছে। সেও আশ্রয় ক্যাম্পের একজন উদ্বাস্তু হিসেবে বিনামূল্যে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
জয়নাল আবেদীন, পিতা: হোসেন আহাম্মদ, সে টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের একজন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। সে বর্তমানে গত ৬/৭ বছর ধরে সপরিবারে উখিয়ার কুতুপালং সংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ির কচুবনিয়া এলাকায় বসবাস করছে। ১৯৯২ সালে অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। শরণার্থী ক্যাম্প থেকে সে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। আরএসওর সামরিক কমান্ডার হিসেবে তাকে অনেকে জানেন। সে দীর্ঘদিন নাইক্ষ্যংছড়ির পার্বত্য এলাকায় থাকার সুবাদে রেজু আমতলী ঠিকানা ব্যবহার করে ০৩০২৯৫৩৭৪৯৩২ নং বাংলাদেশি এনআইডি বানিয়ে নেয়। তার এক ভাই মো. আয়ুব কুতুপালং-২ নং ক্যাম্পে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অধিকাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি কার্ডধারী হয়ে গেছে, অনেকে পাসপোর্ট করে ফেলেছে। ১৯৯২ থেকে শরণার্থী হিসেবে অবস্থানের সুযোগে বাংলাদেশের সর্বত্র তাদের চেনা-জানা হয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনসহ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কও গড়েছে। রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দুটোর শত শত রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছে ও ক্যাম্পে যাতায়াত করছে বলে জানা যায়।
এদিকে মিয়ানমারে থাকতেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট-এর মালিক হয়েছে। আবার ২০১৭ সালের পর এসে দালালদের মাধ্যমে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। একাজে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ঐসব রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী স্বজনরা ও বাংলাদেশি অভিবাসী দালালরা। গত দেড় বছরে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে আসল পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেশের প্রায় সব জেলা ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসগুলো থেকে এ ধরনের কয়েকশ রোহিঙ্গা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এত কড়াকড়ির পরও কীভাবে রোহিঙ্গারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের জানান, আমার দেশের লোকজনরাই রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়তে ও বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু সহযোগীকেও আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তা ছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত অস্থায়ী চেক পোস্টগুলোয় গত ১৮ মাসে ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে আটক করে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল বলে ওসি জানান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট