চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

পাহাড় থেকে পাহাড়ে রঙ ছড়িয়েছে বৈসাবি

মিনারুল হক

৩ মে, ২০১৯ | ৪:৫৪ অপরাহ্ণ

‘বৈসাবি’ পাহাড়ে বর্ষবরণের একটি উৎসবের নাম। ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই ও চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বিঝুকে একসাথে বলা হয় এ বৈসাবি উৎসব। বৈসাবির মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করতে উৎসবের রঙ লেগেছে পাহাড়ে। আনন্দমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে বান্দরবানে ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসব।
গত ১২ এপ্রিল (শুক্রবার) থেকে শুরু হয়ে পাহাড়ে এ ‘বৈসাবি উৎসব’ সপ্তাহব্যাপী। এর মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেন এ অঞ্চলের মানুষ। পাহাড়ে ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে আয়োজন করে থাকে নানারকম কর্মসূচি। রঙ-বেরঙের নতুন পোশাকে শিশু-কিশোররা ঘুরে বেড়ায় এই বাড়ি ওই বাড়ি করে। বর্ষবরণ উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত অনুষ্ঠান মারমাদের পানি উৎসব। এই দিন মৈত্রী পানি বর্ষণের পাশাপাশি নাচে আর গানে পরস্পরকে ভালবাসা ও শুভেচ্ছায় সিক্ত হন তারা। ঠিক এভাবে পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার মাধ্যমে পাহাড়ের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে উঠে বৈসাবি উৎসবে। তবে ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস একমাত্র বান্দরবান জেলায়। উৎসবের নানান রঙ ও বহুমুখী বৈচিত্র্য ফুটে উঠে এখানে। ধর্মীয় ও সম্প্রদায় ভেদে বর্ষবরণ উৎসবকে একেক সম্প্রদায়ের মানুষ একেকভাবে উদযাপন করে থাকে।

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়রা ফুল বিজু দিয়ে শুরু করে বৈসাবি। মূলত বাংলা নববর্ষের দু’দিন আগে থেকে তারা আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে। প্রথমদিন ভোরে বন-ঝোপঝাড় থেকে বুনো ফুল সংগ্রহ করে নদীতে ভাসিয়ে উৎসব উদযাপন করেন শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা। পরের দিন মূল বিজু। এই দিনে নানা পদের সবজি দিয়ে তৈরি করা হয় পাচন। এই সবজিতে থাকে কাঁচা কাঠাল, বরবটি, শিম, আলু ও মূলাসহ নানা রকমের সবজি। বাড়িতে আগত অতিথিদের অন্য খাবারের সাথে পাচন দেয়া হয়। ঘরে ঘরে তরুণ-তরুণীরা বয়স্কদের আশীর্বাদ নেয়। সন্ধ্যায় পাড়ায় পাড়ায় চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাচ-গান। পরের দিন অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের দিন আনন্দ করা হয়। এ দিনটিকে চাকমারা বলে গইজ্জা-গজ্জি বাংলায় যাকে বলে গড়াগড়ি। বা আনন্দ করা। বছরের প্রথম দিনটি আনন্দে আয়েশে কাটায় তারা। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানগুলোও প্রায় চাকমাদের মতো। তারা নববর্ষকে বলে বিসু। তবে তাদের অন্যরকম একটি অনুষ্ঠান হলো ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলা। পাহাড়ের একপ্রকার ফল হলো ঘিলা। এ ঘিলাকে পবিত্র মনে করে তঞ্চঙ্গ্যারা। ঘিলা ফল দিয়ে তরুণ-তরুণীরা অনেকটা মার্বেল খেলার মতো করে প্রতিযোগিতার অয়োজন করে। পাড়ায় পাড়ায় চলে এই প্রতিযোগিতা। পুরস্কারেরও আয়োজন করা হয়। বান্দরবানের বালাঘাটা রেইছাসহ বিভিন্ন এলাকায় এবারও ঘিলা খেলা উৎসবের আয়োজন করা হয় নববর্ষে। এতে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ৩৩টি দল অংশ নেয়। নানা ধরনের নানা রঙের পোশাক পড়ে তরুণ-তরুণীরা অংশ নেয় ঘিলা খেলা ও ফুল ভাসানো উৎসবে।
বর্ষবরণ উৎসবকে ‘চাংক্রান’ নামে পালন করে থাকে ¤্রাে সম্প্রদায়রা। বেশ কয়েক বছর ধরে জাঁকজমকভাবে পালন করা হয় ¤্রাে সম্প্রদায় অধ্যুষিত চিম্বুক এলাকায়। আশপাশে বিভিন্ন পাড়া থেকে প্রচুর লোকসমাগম ঘটে সেখানে। উৎসবে গো-হত্যা নৃত্যের আয়োজন করা হয়। ¤্রাে তরুণ-তরুণীরা বাঁশির তালে তালে নেচে গেয়ে পালন করে চাংক্রান। তরুণীরা এ সময় তাদের নানা ধরনের পুরনো গহনা পড়ে নাচে। এসব গহনাগুলো বংশ পরম্পরায় ব্যবহার হয়ে আসছে। সাথে চলে বিভিন্ন খেলা। তার মধ্যে লাঠি খেলা, পুতির মালা তৈরি ও শক্তি প্রদর্শন প্রতিযোগিতা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় সেখানে। চাংক্রান উৎসবে পুরো চিম্বুক পাহাড় আনন্দময় হয়ে উঠে। সংস্কৃতিকর্মী ইয়াঙান ¤্রাে বলেন, প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে চিম্বুকে পোড়া বাংলা এলাকায় ‘চাংক্রান’ উৎসব পালন করেছে।
‘সাংক্রাইং’ নামে পালন করেছে খুমি সম্প্রদায়রা। রোয়াংছড়ি উপজেলা তারাছা এলাকায় লংথাংপাড়ায় গত ২০ এপ্রিল দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। এবারও নানা আয়োজনে বর্ষবরণ উৎসব পালন করে খুমিরা। তবে তাদের বর্ষবরণ উৎসবটি এখন আগের মতো আর দেখা যায় না।
বর্ষবরণ উৎসবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে মারমা সম্প্রদায়ের মৈত্রী পানিবর্ষণ। তরুণ-তরুণীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। তাদের বিশ্বাস স্বচ্ছ পানির ধারা পুরনো বছরের যত দুঃখ গ্লানি ধুয়ে মুছে দিবে। চন্দন পানিতে বৌদ্ধমূর্তি ¯œানের মধ্য দিয়ে মারমারা সংগ্রাই উৎসব শুরু করে। নববর্ষের আগের দিন তারা ঘর দুয়ার পরিষ্কার করে বয়স্কদের পূজা দেয়। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনায় অংশ নেয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বয়স্কদের প্রণাম করে। পরে শুরু হয় পাড়ায় পাড়ায় মৈত্রী পানিবর্ষণ। এই উৎসবের একটি জনপ্রিয় গান রয়েছে। সেটি হলো ‘সাংগ্রাইয়ে মাঞিঞ্রি ঞাঞারিকাজাইকাইপামে’ এর বাংলা অর্থÑ সাংগ্রাইয়ের বর্ষবরণে চলো, আমরা একসাথে মৈত্রীপানি বর্ষণে যাই। উৎসবের সময়ে এই গানটি সবার মুখে মুখে ফিরে। সুরের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠে মারমা পল্লীগুলো। রাতে পাড়ায় পাড়ায় চলে পিঠাপুলি তৈরির আয়োজন। পরের দিন পিঠা ও মিষ্টান্ন মন্দিরে ভিক্ষুদের উৎসর্গ করা হয়। বান্দরবান শহরের রাজার মাঠে বসে দুই দিনব্যাপী মৈত্রীপানি বর্ষণ প্রতিযোগিতা। সেখানে বিভিন্ন এলাকার তরুণ-তরুণীরা নতুন পোশাক পড়ে পানিবর্ষণে অংশ নেয়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে মঞ্চে। শিশু থেকে শুরু করে যুবক-যুবতি এমনকি প্রবীণরা ও পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে।
উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি হ্লাএমং মারমা জানান, বর্ষবরণের উৎসব পালন করতে শহরে রাজার মাঠে চারদিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন তারা। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৩ এপ্রিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, বয়স্ক পূজা ও পিঠা তৈরি উৎসব। পরের দিন উজানীপাড়ার সাঙ্গু নদীর ঘাটে বুদ্ধ ¯œান। মূলতঃ মারমারা নববর্ষের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ ও ১৬ এপ্রিল মৈত্রী পানিবর্ষণ, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া বর্মী পঞ্জিকা অনুসরণ করে ১৩ এপ্রিল দিয়ে উৎসব শুরু করে খিয়াং ও চাক সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা ফুল দিয়ে ঘর-বাড়ি সাজিয়ে তোলে ও পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। প্রতিবছর বর্ষবরণ উৎসবগুলোতে আদিবাসী ছাড়াও অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট