চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বাউকুল চাষে ঈর্ষান্বিত সাফল্য
বাউকুল চাষে ঈর্ষান্বিত সাফল্য

বিষাক্ত তামাকের আগ্রাসন ঠেকিয়েছে নুরুল ইসলাম

বাউকুল চাষে ঈর্ষান্বিত সাফল্য

আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার

১৫ মার্চ, ২০২০ | ২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের রামু উপজেলার পাহাড়ঘেরা ঈদগড় ইউনিয়ন জুড়ে বিষাক্ত তামাকের আগ্রাসন। অতি লাভের আশায় গ্রামের বহু চাষি ধানি জমিতে তামাক চাষ করছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিলেন নুরুল আলম মেম্বার। তিনি ইউনিয়নের বৌ ঘাট গ্রামের ব্রিজের উত্তর পাশে গড়ে তুলেছেন বাউকুল বাগান।
বিগত আট বছরে নুরুল আলম মেম্বারের দেখাদেখি বহু চাষি তামাক ছেড়ে বাউকুল চাষ করছেন। বাউকুল বিক্রি করে ভালো আয়ও করছেন চাষিরা। নুরুল আলম মেম্বার প্রতিমাসে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করেন বলে জানান।
জানা যায়, ছাত্রজীবন থাকাকালীন পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সবকিছু দেখভাল করতে হত নুরুল আলমকে।
তাই তিনি নেমে পড়েন মৎস্য ও লবণ চাষে। দীর্ঘদিন এই ব্যবসায়ে ছিলেন তিনি। তবে মাঝপথে প্রতিবারে লোকসান হওয়ায় বাউকুল চাষি রহিম উল্লাহর পরামর্শে বাগান করতে আগ্রহী হন। নুরুল আলমের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার সদরের জালালাবাদ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের পূর্ব ফরাজী পাড়ায়। তিনি একই এলাকার জাকারিয়ার ছেলে এবং বর্তমানে ইউপি সদস্য (মেম্বার)।
মৎস্য এবং লবণ চাষে যখন লোকসানে পড়ছে তখন কোন পেশা তার ভাল লাগছিল না। শিক্ষিত এবং সবার প্রিয়জন হওয়ায় আরেক সমস্যা। ছোটখাট ব্যবসা বাণিজ্যও তার কোনো কাজে আসছে না। ঠিক এ সময়ে সিদ্ধান্ত নেন বাউকুল বাগান করার।
পরামর্শ নেন কৃষক রহিম উল্লাহর। তারপর শুরু করেন চাষ। বাউকুল চাষের সাফল্য দেখে মনস্থির করেন নিজেই একটি বাগান করবে। স্বপ্ন দেখেন বাউকুল বাগান করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
২০১১ সালের দিকে লবণ ও মৎস্য চাষ ফেলে পুরোটাই সিদ্ধান্ত নেন বাউকুল চাষের। তারপর নিজ বাড়ি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ঈদগড় ইউনিয়নে জমি খুঁজতে থাকেন। তখন ঈদগড় ইউনিয়ন জুড়ে তামাক আর তামাক। তিনি স্থানীয় লোকজনকে বুঝিয়ে বাউকুল বাগানের জন্য বৌ ঘাট ব্রিজের উত্তর পাশে ৫ একর পতিত জমি ইজারা নিলেন। এরপর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন বাউকুলের বাগান তৈরির কাজ। কাজ শুরুর পর খরচ হয় আরো অধিক টাকা। ময়মনসিংহ থেকে বাউকুলের চারা আনা হয় ৫ শতাধিক। বাগানের নামকরণ করা হয় মেম্বার বহুমুখী এগ্রো ফার্ম।
নুরুল আলম বলেন, প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে তৈরি করা এই বাগানে ২০১৩ সালে ৫শ গাছে ফল ধরতে শুরু করে। ওই বছর কুল বিক্রি করে পান মাত্র অল্প টাকা। লোকসান দেখে লোকজনও বলাবলি শুরু করেন এ বাগানেও সফলতা আসবে না। পরের বছর আরও খারাপ অবস্থা। বাগানের কুল বিক্রি করে পেয়েছিলেন মাত্র দেড় লাখ টাকার মতো। ঈদগড়ের তামাক ব্যবসায়ীরা নানা অপপ্রচার শুরু করেন। এতে তিনি ভেঙে পড়েননি। ২০১৩ সালে তিনি পরামর্শের জন্য যান জেলা কৃষি অফিসারের কাছে। সার্বক্ষনিক পরামর্শ দেন কৃষি অফিসারগণ।
তারাও নুরুল আলমের পাশে দাঁড়ান এবং বাগান পরিদর্শনে আসেন। তারপর বাউকুল চাষ পদ্ধতি দেখিয়ে দিলেন বিএ পাশ করা অদম্য চাষী নুরুল আলমকে। ওই বছরই বাগানে বাম্পার ফলন হয়। গাছের কুল বিক্রি করে নুরুল আলমের আয় হয় ৪ লক্ষ টাকা।
বাগানে কর্মসংস্থান হয় এলাকায় ১৫ জন বেকার যুবকের। যাদের বেতন মাসিক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মতো।
নুরুল আলম জানান, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকায় বেশি থাকতে হয়। বিভিন্ন মিটিং এবং ঘরোয়া বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হয় অধিক সময়। এ কারণে বাগানের দেখভাল তেমন সম্ভব হয় না। আর তাই লোকসান গুনতে হত প্রায় সময়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এক ধরনের ছত্রাকের (কা- পচা রোগ) আক্রমণে গাছের ফুল ও কুল ঝড়ে পড়ে। এ কারণে আশানুরূপ কুল উৎপাদিত হয়নি।
সরেজমিনে ঈদগড় বৌ ঘাট ব্রিজের উত্তর পাশে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ঘেরা আর ধানী জমির বিশাল এলাকাজুড়ে বাউকুল বাগান ‘মেম্বার বহুমূখী এগ্রো ফার্ম’। নুরুল আলম মেম্বারসহ কয়েকজন শ্রমিক গাছ থেকে কুল ছিঁড়ছেন আবার পরিচর্যা করছেন। ব্যবসায়ীরা সেই কুল গাড়িতে করে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছেন।
নুরুল আলম জানান, বাগানের ৫ থেকে ৬শ মতো গাছে বাউকুল ধরেছে। প্রতিটিতে বাউকুল পাওয়া গেছে গড়ে ১৭ থেকে ১৮ কেজি করে। বিক্রি হচ্ছে খুচরা প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে। পাইকারি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এই বাগানের বাউকুল খুবই মিষ্টি। তাই চাহিদাও বেশি। জেলার চাহিদা পূরণ করে এই বাগানের বাউকুল সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। লাভবান হওয়ায় গ্রামের অনেকে বিষাক্ত তামাক চাষ ছেড়ে বাউকুল চাষে এগিয়ে আসছেন। বর্তমানে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে লাখ টাকা আয় হচ্ছে নুরুল আলম মেম্বারের।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট