চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দীঘিনালার গভীর অরণ্যে প্রাকৃতিক ‘বাদুর গুহা’র সন্ধান

জাহাঙ্গীর আলম রাজু হ দীঘিনালা

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩০ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একটি প্রাকৃতিক গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে দুর্গম রথিচন্দ্র কারবারীপাড়া নামক এলাকার গভীর অরণ্যে এ প্রাকৃতিক গুহার অবস্থান। সবুজ বনবীথি ঘেরা এই গুহার পাশেই রয়েছে মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি ঝরনা ও নানা আকৃতির পাথরবেষ্টিত পাহাড়ি ছড়া। গুহার ভিতরে রয়েছে অসংখ্য বাদুর। তাই স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায় প্রাকৃতিক এই গুহার নাম দিয়েছেন তাবাক্ষ। তাবাক্ষ মানে বাদুর গুহা। কোন একসময় এই গুহার ভিতরে বৌদ্ধভিক্ষুরা ধ্যান করতেন বলেও এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। লোকজনের তেমন একটা যাতায়াত না থাকায় গুহার ভিতরে বাদুর অবস্থান নিয়েছে বলে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়।

গুহার ভিতরে প্রবেশ করার পর পরিবেশ এবং ওপরের অংশের ছাদ দেখে যেকোন মানুষেরই মনে হতে পারে যে গুহাটি কোন রাজমিস্ত্রির নিপুণ নির্মাণশৈলিতে তৈরি করা হয়েছে। তাই গুহাটিকে কেউ কেউ বৃটিশ সৈন্যদের ব্যাংকার হিসাবেও মন্তব্য করেছেন। তবে বাস্তবে তার কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। যারা প্রাকৃতিক এই গুহাটি ঘুরে দেখেছেন তাদের মতে, পাহাড়ের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক গুহা এটি। তাই স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পর্যটন কর্তৃপক্ষ যদি উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে প্রাকৃতিক এই গুহা এবং পাহাড়ি ঝরনা ও নানা আকৃতির পাথরবেষ্টিত পাহাড়ি ছড়াকে ঘিরে রাথচন্দ্র কারবারীপাড়ায় গড়ে উঠতে পারে পাহাড়ের সবচেয়ে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র এমনটাই মনে করছেন তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, গুহাটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে নানা প্রজাতির বন-বনানী। পাশেই বহমান নানা আকৃতির পাথরবেষ্টিত একটি পাহাড়ি ছড়া। একটু দূরে তাকাতেই চোখে পড়ে মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি ঝরনা। পাহাড়ের চূড়া থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে ঝরনার পানি। বনের পাখির কলকাকলি আর ঝরনার কলতানে প্রাকৃতিক এই গুহাকে ঘিরে বইছে মন মাতানো পরিবেশ। গুহার প্রবেশ পথটি বনলতার আবরণে ঢাকা। তবে ভিতরের পরিবেশ অনেকটাই পরিচ্ছন্ন। গুহাটির প্রস্থ তেমন একটা বড় না হলেও দৈর্ঘ্য আনুমানিক দু’শ ফুট। প্রায় ৩০-৪০ ফুট উচ্চতার এই গুহার ওপরের অংশটি নিপুণতায় ভরপুর। গুহার ভিতরে প্রবেশ করার পর অসংখ্য বাদুর ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। তবে ভিতরের প্রগাঢ় অন্ধকার। তাই বাঁশের মশাল নিয়ে প্রবেশ না করলে গুহার ভিতরে কিছুই দেখা যায় না। গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা স্থানীয় পর্যটক অজিত বড়–য়া, পার্পল দেওয়ান ও হিরণ ত্রিপুরার সাথে কথা হয়। তারা জানান, দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে এত সুন্দর প্রাকৃতিক গুহা আছে তা আমাদের জানা ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য এবং আয়তনের দিক থেকে এটি পাহাড়ের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গুহা। এই প্রাকৃতিক গুহা এবং পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়াকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে এটি হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র।
দুর্গম পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দা রামেন্দ্র লাল ত্রিপুরা জানান, প্রাকৃতিক এই গুহাটি আমরা তাবাক্ষ নামেই চিনি। গুহার ভিতরে অসংখ্য বাদুর থাকে। তবে গুহার ভিতরে দেবতাদের অবস্থান রয়েছে বলে এলাকার অনেকেই মনে করেন। তাই আমাদের ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন সহজে এই গুহার ভিতরে প্রবেশ করতে চায় না। গুহাটি অনেক বড় ও সুন্দর। তাই অনেক আগে বৌদ্ধভিক্ষুরা এই গুহার ভিতরে ধ্যান করতে আসতেন বলে মা-বাবার কাছে শুনেছি। তবে বর্তমান কোন বৌদ্ধভিক্ষু এখানে আর ধ্যান করতে আসেন না। সম্প্রতি প্রাকৃতিক এই গুহাটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন দিঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ। পরিদর্শনশেষে তিনি জানান, একইসাথে প্রকৃতির এতরূপ আমি পাহাড়ের আর কোথাও দেখিনি। তাই দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম এই পাহাড়ি জনপদকে ঘিরে

দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

ইউপি চেয়ারম্যান কাশেম জানান, রথিচন্দ্র কারবারীপাড়ায় দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক গুহার সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি এলাকাবাসীর জন্য আনন্দের। আমরাও এটিকে পর্যটনবান্ধব এবং নান্দনিক সাজে সাজাতে চাই। ইতিমধ্যে আমরা মাইনী নদীর ওপর আন্তর্জাতিকমানের দৃষ্টিনন্দন হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণের পাশাপাশি তৈদুছড়া ঝরনা ও রথিচন্দ্র কারবারীপাড়া প্রাকৃতিক গুহাকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।

যেভাবে যেতে হবে এই প্রাকৃতিক গুহায়:জেলা কিংবা উপজেলা সদর থেকে যেকোন যানবাহনযোগে দীঘিনালাÑখাগড়াছড়ি সড়কের ৮ মাইল নামক স্থানে পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে চাঁদের গাড়ি কিংবা মোটর সাইকেলযোগে যেতে হবে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রথিচন্দ্র কারবারী পাড়ায়। সেখান থেকে আনুমানিক দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে পৌঁছতে হবে দৃষ্টিনন্দন এই প্রাকৃতিক গুহায়। তবে গুহার কাছাকাছি পৌঁছার পর প্রথমেই পরবে নয়নাভিরাম পাহাড়ি ঝরনা। এই ঝরনার পাশদিয়েই পাহাড়ি লতা ধরে নামতে হবে ঝরনার নিচের পাহাড়ি ছড়ায়। ছড়ায় নেমে হরেক রকম পাথর দেখতে দেখতে ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় দৃষ্টিনন্দন এই প্রাকৃতিক গুহায়। তবে গুহায় প্রবেশ করতে হলে সাথে অবশ্যই বাঁশের মশাল কিংবা লাইটের আলো থাকতে হবে। তবে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট