চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গল্প হলেও সত্যি

ছন্দা দাশ

৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

মাঝে মাঝে সময় বড় জ্বালায়। কোন কিছুতেই যেন মন বসতে চায় না। সব কিছুই বিক্ষিপ্ত। জোর করে কোন কিছুতেই মনকে বাগ মানাতে না পেরে বিফল মনোরথ হয়ে বেরিয়ে আসি পথে। পথের বিচিত্রতা মনকে যদি নাড়া দেয়। এমনই এক বিকেলে দেখতে পেলাম মন্দিরাকে রাস্তা পার হতে। ওকে দেখে আমি দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করবার আগেই বিপরীত দিক থেকে একটা বাস এসে আমাদের আড়াল করে দেয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আর বাসটি চলে গেলে দেখি মন্দিরাও নেই। বাসে উঠে গেল নাকি মিশে গেছে জনারণ্যে কে জানে? মন বিষাদে ভর করে আবার। তার কথা ভাবতে ভাবতে আবার বাড়ির পথ ধরি। অনেক আগে মন্দিরা আমার বাড়ির কাছেই থাকতো। আর আমার সাথে বেশ ভাব গড়ে উঠেছিল। সময় অসময়ে এসে রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতো। মাঝে মাঝে আমিই বলতাম তোর মুখে কি নাপিত তার ক্ষুর ছুঁয়ে দিয়েছে? তার সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু ওর সরলতা আমাকে মুগ্ধ করতো। মন্দিরার সাথে গল্পে গল্পে একসময় আমার জানা হয়ে যায় তার জীবনের অন্য আরেক বেসুরের কান্না।

তার দা¤পত্য অসুখের গল্প। মন্দিরা খুব হাসি খুশি উচ্ছ্বল একটি মেয়ে। সে চায় জীবনকে নিজের মতো করে পেতে। কিন্তু তার স্বামী তরুণ নামেই তরুণ। বাস্তবে তার কোন প্রকাশ নেই। বয়সেরও অনেক ব্যবধান। দুজন অসম বয়সী যুগলের জীবনের করুণ পরিণতি একটু একটু করে রোজ আমি শুনে জীবনের অংক মেলাবার চেষ্টা করি। যদিও তরুণ সৎ, চরিত্রবান, ভদ্র, সদালাপী কিন্তু তার কোন উচ্ছ্বাস নেই। ঘোর বাস্তববাদী। জীবনে হিসেব কষে পা ফেলে। দুজন দুই পৃথিবীর মানুষ। এ নিয়ে মন্দিরার অনুযোগের শেষ নেই তাই সে আমার কাছে ছুটে ছুটে চলে আসে। আগডুম বাগডুম করে সময় কাটায়। মেয়েটার জন্য আমার খুব মায়া হয়। খুব বেশি কিছু তো চায়নি। কি হতো তার মতো তরুণ যদি একটু রোমান্টিক হতো? তরুণ যে মন্দিরাকে ভালোবাসে না তা কিন্তু নয়। একটু বেশিই বাসে। কিন্তু সে আটপৌরে চরিত্রের ছাপোষা কেরাণীর মতো। সেখানে না আছে সুর, না কবিতা, না আকাশ দেখার মতো মন। মন্দিরা চায় পাখির মতো, নদীর মতো, ফুলের মতো জীবন হোক। জ্যো¯œার আলোয় সিক্ত হয়ে গান গেয়ে জীবন চলুক। তরুণের এসব পছন্দ নয়। সে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে সময় মতো খায় আর ঘুমায়। আনন্দ বলতে ভবিষ্যত জীবনের হিসেব নিকেষ।

এক একদিন মন্দিরার মন খারাপ যখন চরমে চলে যায় তখন ছুটে আসে আমার কাছে। কেঁদে ভাসায়। আমি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। তরুণকে অবশ্য এ নিয়ে কখনো ঝগড়া করতে শুনিনি। সে শুধু হাসে আর বলে ঠিক হয়ে যাবে দিদি। তুমি চিন্তা করো না। বয়স কম কিনা তাই এখনো বোঝে না। তরুণকে আমি ছাত্রাবস্থা থেকে দেখেছি অত্যন্ত সৎ, বিনয়ী আর ভদ্র। বয়োসচিত পরিপক্কতা একটু বেশি। তাই গুরুগম্ভীর আর বাস্তববাদী।

সেখানে কল্পনার কোন রঙীন ফানুস উড়ে না। একদিন মন্দিরা খুব উত্তেজিত হয়ে ঝড়ের মতো আমার বাসায় এসে বলে দিদি আমি আর পারছি না। এবার আর ফিরবো না ওর সংসারে। আমি হেসে বলি বেশ তো ডিভোর্স দে তবে। সে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয় দেবই দেব। তুমি দেখে নিও। কিন্তু ডিভোর্স দিতে কোন দোষটা দিবি? সবাই তো জানে তরুণ খুব ভালো ছেলে। সে চুপ হয়ে যায়। আর একটু কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলি দেখ সবারই কিছু না কিছু দোষ তো থাকে। তোর আমার। কিন্তু তরুণের তো চরিত্রের দোষ নেই। সে তো তোকে খুব ভালোবাসে। আমি তো জানি তাকে সেই ছোটবেলা থেকে। কখনো কোন মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত। মন্দিরা এবার যে উত্তর দিলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তার উত্তর সেদিন আমাকে জীবনের আর দিকের পর্দা উন্মোচন করেছিলো। সে হেসে বলে দিদি তুমি ভুল ভেবেছো। তরুণ যদি তখন একাধিক প্রেমও করতো আমি কিছু মনে করতাম না। তাহলে সে আজ আমাকেও ভালোবাসতে জানতো। সে তো ভালোবাসা কি তাই জানে না। আমি অবাক হয়ে ভাবছি তবে কি সেই ছেলেটির কথা সত্যি যে বলেছিল মেয়েদের বেশির ভাগই অসৎ আর চরিত্রহীন ছেলেদের প্রেমে পড়ে। দিন চলে যাচ্ছিল দিনের মতো। আমিও ব্যস্ত আমার সংসারের শত বেড়াজালে। ইতিমধ্যে মন্দিরারা বাসা বদল করে চলে যায় অন্য জায়গায়। যাবার আগে দেখা করে গিয়েছিল। এ নিয়ে আর কোন বিরোধ হয় নি তেমন। আমিও ভেবেছি এ ঝড় একসময় থেমে যাবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তেমন হলে আমি খুশিই হতাম। আমার এ গল্প এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। এক দুপুরে আমি কি কাজে নিউমার্কেটে ঢোকার মুখে দেখি অন্য গেট দিয়ে তরুণ একটি সাদা রঙের গাড়ি থেকে নামছে। তার পিছু পিছু নামছে বেশ সুন্দরী এক মহিলা। আমি খুব অবাক হলাম। এ তো তরুণের সাথে কিছুতেই মেলে না। আমি আরও একবার ভালো করে দেখে নিলাম। চেনা মনে হলো না মহিলাকে। কে এই মহিলা? আর তরুণই বা গাড়ি কিনলো কখন? মন্দিরা তো কিছু জানায়নি? তার ছা পোষা কেরাণী মনোভাব কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে আমি আমার কাজে ঢুকে পড়ি। কিন্তু সারাদিন মাথা থেকে ঐ দেখা কিছুতেই সরাতে পারছি না। রাতে সব কাজ সারা হলে মন্দিরাকে ফোন করি। যা ভেবেছি তাই। ওরা গাড়ি কিনেছে। বাড়িও কিনবে। দেখে রেখেছে। এ খবরে মন্দিরার গলায় যেমন খুশির ভাব থাকা উচিৎ ছিল তা যেন নেই। আমিও পারছি না দুম করে বলে ফেললাম আমার আজকের দেখার কথা।

অভিনন্দন জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। আবার ভুলেও গেলাম সে ঘটনা। কিন্তু আমি কমলিকে ছাড়লে কি হবে কমলি আমায় ছাড়ে না। ঠিক আর এক সন্ধ্যায় চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে দেখি তরুণ আর সেই মহিলা। এবার আর আমার সন্দেহ রইলো না। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে বেরিয়ে আসি। আবার মন্দিরাকে ফোন করি। আর মন্দিরাকে সে কথা বলতেই বুঝলাম সে সব জানে। আমি বলি এখন তরুণ তোকে ভালোবাসতে শিখেছে? ওপাশে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট