চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিদায়! নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ দিল মনোয়ারা মনু আপা

ডেইজী মউদুদ

১৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে আমাদের আকাশে উড়ছিল আলো ঝলমল ফানুসবাতি একের পর এক। রঙিন ফানুস এর আবীরমাখা রোশনাই আর পূর্ণিমার চাঁদের অবারিত জোছনা মিলে পৃথিবীতে সেদিন রচনা করেছিল অপূর্ব এক সুন্দরের মেলবন্ধন। আর এমনই এক শুক্লা দ্বাদশীর রাতে, তারাভরা আকাশ থেকে যখন গলে গলে পড়ছিল জোছনার মায়া, আমাদের অতি প্রিয় (দিল মনোয়ারা মনু) আপা, সেই রাতে অকস্মাৎ আপনি চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। কাউকে কিছু না জানিয়ে পাড়ি দিলেন পরপারে।

পরের দিন সকাল থেকে ফেসবুকের পাতাগুলো ভরে গেছে তাঁর শোকগাঁথায়। শোক সংবাদ থেকে শুরু করে সুহৃদদের নানান বেদনার্ত কমেন্টস এ সয়লাব হয় এফবির পাতা।

এমন মায়াবী অভিভাবক হারিয়ে সারথীরা নির্বাক হন। তার আগের দিনেও তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিলেন সচল বলেছেন অনেকেই। আমার পোস্টেও ছিল তাঁর সাবলীল ও সুন্দর এক কমেন্টস। নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমার একটি ছোট্ট পোস্ট ‘মনু আপা আর নেই’ এরপর থেকে তাঁর ¯েœহাস্পদদের সকলের পোস্টে একটি সুর ‘তিনি সবাইকে বেঁধেছিলেন পরম মমতা ¯েœহ আর মায়ার বন্ধনে।’

প্রবর্তনার কর্ণধার ফরিদা আকতার লিখেন, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনার বিভিন্ন কাজে মনু আপার সহযোগিতা পেয়েছি সব সময়। কত সময় তিনি কতভাবেই তিনি আমাদের কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।
জুনান নিশাত লিখেন, মনু আপা গভীর আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরেছে বহুবার। কিন্তু সেদিনের সে আলিঙ্গনই যে হবে জীবনের শেষ আলিঙ্গন, তা কে জানতো? মনু আপা আপনার মমতাভরা নিবিড় আলিঙ্গনের ছবি শেষ স্মৃতি হয়ে আমাকে কাঁদাবে প্রতিক্ষণ।

কলামিস্ট, পাক্ষিক অনন্যার সাবেক নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু গত ১৩ অক্টোবর রাতে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি … … রাজিউন)। রাতে শ^াসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
নারী আন্দোলন সহ বিভিন্ন প্রতিবাদ ও আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ছিলেন। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির গণমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্সসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। দিল মনোয়ারা মনু ছিলেন মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি, ছিলেন গভীরভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ এক মানুষ। একুশের পথ ধরে বাংলার নারীদের নিরন্তর এগিয়ে চলার প্রতি তাঁর ছিল অবিচল আস্থা। তিনি বিশ^াস করতেন একুশ কোন নির্দিষ্ট দিবস নয়, এক অবিরাম সৃষ্টিশীল ধারারই নাম।
ফরিদপুরে ১৯৫০ সালে দিল মনোয়ারা মনু জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান বেগম সম্পাদিত ‘বেগম’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। ১৯৮৮ সালে থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত পাক্ষিক ‘অনন্যা’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ‘বেগম’ পত্রিকা সম্পাদক নুরজহান বেগমের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। তবে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা বেগম সুফিয়া কামালের হাত ধরেই ’৭৪ সালে। তিনি সবে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছেন, তখনই তিনি ‘বেগম’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। তিনি সে সময় কাজ করেছেন কবি হাবিবুর রহমান, আবুল হাসনাত এবং মকবুলা মনজুরের সাথে। তিনি সান্নিধ্য পান সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন, নুরজাহান বেগম এবং রোকোনুজ্জামান খান দাদাভাই এর। ফলে নারী জাগরণ, নারীর মানবাধিকার ও নারীর মৌলিক অধিকারগুলোর জন্য কাজ করতে তিনি পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি নারী সাংবাদিতকায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ‘বেগম’ আর ‘অনন্যা’র মধ্য দিয়ে শত শত নারীদের লেখালেখির পথ সুগম করে নিজেই হয়েছেন অনন্যা। তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা ঢাকায় নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। সেই মধু মুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই মায়াভরা আঁখি দিয়ে তিনি আমায় আবদ্ধ করেছিলেন কি একটা মায়ার জালে, পরম মমতায়। তবে ফেসবুকে আমি প্রতিদিন তাঁকে পেয়েছি সরব। আমার প্রতিটি লেখা এবং ছবিতে তাঁর কমেন্টস থাকতোই। চিরতরে চলে যাবার আগেরদিনও তিনি কমেন্টস দিয়ে আমায় প্রাণিত করেছিলেন। আজ আমি ভাবতে পারিছি না তাঁর আইডি থেকে আর কোন কমেন্টস, কোন পোস্ট আসবে না। আপা, সুন্দর মনের মানুষগুলো কি এভাবে হঠাৎ চলে যায়? আপনি যেখানে থাকুন ভালো থাকুন এই কামনা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট