চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মা দিবসের ভাবনা ও কিছু কথা

মেহের নিগার

৮ মে, ২০১৯ | ১:২৬ পূর্বাহ্ণ

বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বিশ্বে প্রতিদিন কোন না কোন দিবস পালিত হয়। প্রতিটি দিবসের রয়েছে আলাদা স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। এ সমস্ত দিবস ঘিরে চলে নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠান। আর এ দিবসগুলোর মধ্যে ‘মা দিবস’ হচ্ছে একটি। এ দিনে সন্তানেরা তাঁদের মাকে সম্মান, শ্রদ্ধা জানাতে একান্তে কাছে টেনে নিতে চায়। তবে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা জানাতে কোন দিন ক্ষণের প্রয়োজন হয় না। কারণ মায়ের প্রতি এই ভালোবাসা চির দিনের, চির শাশ্বত। সন্তান জন্ম নেয়ার পর থেকে তাঁর প্রতি মায়ের থাকে অকৃত্রিম ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। হৃদয়ের সবকিছু উজাড় করে সেবা, যত্ন দিয়ে বড় করেন। মনের কোনায় জমা থাকে হাজার স্বপ্নের চারা গাছ। তাই মায়ের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান জানাতে বছরের কোন নির্দিষ্ট দিনকে পালনই যথেষ্ট নয়। সেটা হওয়া চাই প্রতি ক্ষণ, প্রতি মুহূর্ত ও প্রতি দিনের জন্য।
বিশ্বে প্রতি বছর ‘মা দিবস’ উদযাপন হয় মে মাসের দ্বিতীয় রোববার। এই দিনে দূরে থাকা সন্তানেরা তাঁর মায়ের কাছে ছুটে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরেন, একান্ত কাছে টেনে নেন। মায়ের জন্য নিয়ে আসেন উপহার সামগ্রি। কেউ উপহার দেন কার্ড, ফুলের তোড়া। কেউ বা কেক কেটে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করেন। ‘মা দিবসে’র ইতিহাসের ব্যাপারে জানা যায়ঃ এ দিবসের প্রথম শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আর এই দিবসটির প্রবক্তার নাম আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস। তাঁর মায়ের নাম আন মরিয়া রিভস জার্ভিস। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও সমাজসেবী। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০৫ সালে আন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর মেয়ে আনা মায়ের সেই স্বপ্ন পুরণের কাজ শুরু করেন। সকল মাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি দিবসের প্রচলন তিনি চালু করেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে আনা পশ্চিম ভার্জিনিয়ার একটি গির্জায় তাঁর মায়ের স্মরণে একটি অনুষ্ঠান করেন। এবছর মার্কিন কংগ্রেস ‘মা দিবস’কে স্বীকৃতি দিলেও এই দিবস সরকারি ছুটির ঘোষণা দেয়নি। তবে এ ব্যাপারে আনা তাঁর চেষ্টা চালিয়ে যান। তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভন্ন অঙ্গ রাজ্যে ‘মা দিবস’ পালন শুরু হয়। পরবর্তীতে আনার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৪ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মে দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন এবং এই দিন সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। আনা মারিয়ায় এই মহতি উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে বছরের কোন এক নির্দিষ্ট দিনকে মায়ের জন্য বরাদ্দ না করে, মায়ের জন্য ভালোবাসার দ্বার প্রতি ক্ষণ, প্রতিদিনের জন্য উম্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। কারণ পৃথিবীতে মায়ের কোন তুলনা হয় না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম নিবিড় স¤পর্ক যার সাথে, যে শব্দটির সাথে আত্নার গহিন স¤পর্ক রয়েছে, সে শব্দটি হচ্ছে মা। মানবিক অকৃতিম ভালোলাগা এবং ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপাদান যেখানে নিহিত, সেই শব্দটি হচ্ছে ‘মা’। মায়ের সাথে সন্তানের রয়েছে আত্মিক স¤পর্ক। যেখানে নেই কোন দাগ, কালিমা। যে স¤পর্কটা চিরকালীন ও চির শ্বাশত। মাকে নিয়ে কিছু ধ্রুপদী কাহিনী আছে। এক প্রেমিকা ভালবাসার পরীক্ষা হিসেবে তাঁর প্রেমিকের মায়ের হৃৎপি- চাইলে প্রেমিক বাসায় এসে তাঁর মাকে বুক পেতে দিতে বললে মা তাই করেন। অবশেষে প্রেমিকার বাড়ির কাছাকাছি দৌড়ে হৃৎপি- নিয়ে পৌঁছার পূর্বে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে মা বলে ওঠেন ‘ব্যথা পেলি বাবা?’
অন্য একটি হৃদয় ¯পর্শ করা ‘আমার মা’- নামক বিদেশী গল্প না লিখে পারছি না। আমার মায়ের চোখ মাত্র একটি। অন্যটি গোলাকার ফাঁকা, গর্তটা দেখতে ভয়ঙ্কর। তাই মাকে বীভৎস দেখায়। আমি আমার মাকে খুব ঘেন্না করতাম। আমার মাকে যে কেউ দেখলে ভয় পেতো। সংসার তিনি চালাতেন। স্কুলের বন্ধুরা মাকে দেখলে আমি বিব্রত বোধ করতাম। আমি ঝামেলায় পড়ে যেতাম। আমার সহপাঠীরা আমাকে বলতো কী রে তোর মায়ের এক চোখ কানা। ছি! ছি! আমি রাগ করে বলতাম, মা তুমি মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই। আমার বেহায়া মা এ উক্তির কোনদিন প্রতিবাদ করতো না। আমি বড় হয়ে শহরে অন্যত্র চলে গেলাম। অনেক বছর পর আমাকে না দেখার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন আমার শহরের বাসায় মা চলে এলেন। নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়েরা দরজায় তাঁকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং ঠাট্টা করতে লাগল। হৈ চৈ শুনে আমি তাঁকে দেখে এ অবস্থায় চলে যেতে বললাম। বিনা দাওয়াতে তুমি কেন এখানে এসেছ? তোমার কত বড় দূঃসাহস আমার বাচ্চাদের ভয় দেখাতে এসেছ? কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন আমি দুঃখিত একটা ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি, বাবা। তারপর আমার মা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। ছোটবেলার গ্রামের স্কুলের পুনর্মিলন অনষ্ঠান শেষে আমি ভাবলাম গ্রামের বাড়িটি দেখে যাই, তাছাড়া কানা বুড়িটাতো ওখানে থাকে। আমি গিয়ে শুনলাম আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। শুনে আমার কান্নাও পেল না। প্রতিবেশিরা বললেন, মৃত্যুর আগে তোমার মা একটা চিঠি লিখে দিয়ে গেছে। তাঁরা আমাকে সেই চিঠিটা পড়তে দিলেন। কি লিখা আছে সেই মহীয়সী মা এর চিঠিতে। চিঠিটা নি¤œরূপ।
‘প্রিয়তম সোনা লক্ষ্মী আমার, আমি সব সময় তোমার কথা ভাবি। বাছা ধন, আমি খুব দুঃখিত যে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার আদরের সন্তানদের ভয় দেখিয়েছি। গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছি তুমি স্কুলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে আসবে। শুনে আমার খুব আনন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার শরীরটা এতো খারাপ যে আমি জানি না তোমার সাথে আমার সে সময় দেখা হবে কি না। তুমি যখন বড় হয়ে উঠেছিলে আমি বার বার তোমাকে বিব্রত করেছি বলে সত্যিই খুব দুঃখিত। তুমি যখন খুবই ছোট ছিলে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল। তুমি বাঁচবে মাত্র একটা চোখ নিয়ে আর আমার থাকবে দু’টো চোখ তা কি হয়? আমি তোমাকে আমার একটা চোখ দিয়ে দিলাম। আমি তোমাকে নিয়ে খুবই গর্বিত। আমার একটা চোখ দিয়ে তুমি নতুন পৃথিবীটাকে আমার হয়ে দেখতে পাচ্ছ। এর চেয়ে বড় আনন্দ একজন মায়ের জন্য আর কি হতে পারে। তোমার জন্য সকল ভালবাসা।
– তোমার মা।
মায়ের শূন্যতাবোধ তখনই অনুভুত হয়, যখন সেই প্রিয় মা কে আর পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মা দিবসের এই লেখা লিখতে গিয়ে আজ নিজের মায়ের কথাই খুব বেশি মনে পড়ে গেল। পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য থাকলো শ্রদ্ধা, শুভ কামনা। যেসব মায়েরা বেঁচে নেই তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আমরা যেন সবাই বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাদের মায়েদের কদর করতে পারি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট