চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পাহাড়ী কন্যার ‘ফিফা’ জয়

হুমায়ুন কবির কিরণ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেক রেফারিরই স্বপ্ন থাকে ফিফার তালিকায় নাম লেখানোর। অবশেষে সেই স্বপ্নদুয়ার খুলতে যাচ্ছে জয়া ও সালমার। দু’জনই হতে যাচ্ছেন ফিফা রেফারি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে ফিফা রেফারি হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণের সর্বশেষ হার্ডলটা পার হতে পেরেছেন দু’জনই। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ফিফার তালিকাভুক্ত রেফারি হয়ে যাবেন জয়া ও সালমা। ২০২০ সাল থেকে পরিচালনা করতে পারবেন দেশ-বিদেশে ফিফার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

ফিফার দেয়া কঠিন পরীক্ষায় পাস হয়ে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফিফা রেফারি হতে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইতিহাস বিভাগের ৩৯তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সমাপনী উৎসবের (র‌্যাগ উৎসব) রাণী জয়া চাকমা। গত ২৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় জয়াকে। এতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চার হাজার মিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। এছাড়া যেতে হয়েছে আরও কিছু কঠিন পরীক্ষার মধ্যে। সব পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন জয়া।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর ২০১০ সালে রেফারিং জগতকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জয়া চাকমাকে। লেবেল ৩, ২ ও ১ কোর্স করে ন্যাশনাল রেফারি হয়েছেন আগেই, এবার ফিফা রেফারি হওয়ার ফিটনেস টেস্টে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন। এখন শুধু ফিফা থেকে স্বীকৃতি মেলার অপেক্ষা। আর তা মিললেই জয়া চাকমা হবেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফিফা রেফারি। ফিফার স্বীকৃতি মিললে ২০২০ সালের জন্য জয়া চাকমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় দলের ম্যাচ পরিচালনা করতে পারবেন।

রাঙামাটির মেয়ে জয়া চাকমার মন সারাক্ষণ পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার জয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনাকারী রেফারি। যদিও এরপরে বাংলাদেশের আরেকজন রেফারি সালমা আক্তারও আন্তর্জাতিক ম্যাচ চালিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা সাফে দুটি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন জয়া। একসময় হ্যান্ডবলও খেলতেন। তবে ফুটবলটাই ছিল জয়ার ধ্যানজ্ঞান। ২০০৬ সালে রাঙামাটিতে মাস তিনেকের একটা ফুটবল ক্যাম্প করেন। এরপর ঢাকায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আন্তজেলা ফুটবলে অংশ নিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করেন রাঙামাটিকে। অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য জাতীয় দলে ডাক পান জয়া। ঘরোয়া ফুটবলের পাশাপাশি ইন্দো-বাংলা গেমস, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাই টুর্নামেন্ট ও ২০১০ এসএ গেমসে খেলেছেন তিনি। ২০১২ সালে দল থেকে বাদ পড়লে আর খেলাটা চালিয়ে যাননি। এরপর বিজেএমসিতে চাকরি হয়ে যায় জয়ার। ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ফুটবলার ছিলেন বলেই রেফারিংয়ে আগ্রহী হন জয়া। ২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু জয়ার। এরপর একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পরিচালনা করেছেন শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে। ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে চালিয়েছেন দুটি ম্যাচ।
যখন বাংলাদেশে মহিলা কোচের সংস্কৃতি শুরু হয়নি ওই সময় রেফারিংয়ের চ্যালেঞ্জটা নেন জয়া। চ্যালেঞ্জটা স্বাচ্ছন্দ্যেই নিয়েছেন তিনি, ‘দেশের বাইরে গেলে অনেকেই প্রশ্ন করে তুমি কোন ক্যাটাগরিতে রেফারিং করো? যখন শোনে আমি এখনো ফিফা রেফারি হয়নি, তখন একটু অবাক হয়। বেশি অবাক হয় বাংলাদেশে কোনো ফিফা নারী রেফারি নেই শুনে।’ খেলাধুলা জয়াকে এনে দিয়েছে শক্ত অবস্থান। জয়ার মতে, ‘খেলাধুলা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। স্বাবলম্বী করেছে। সম্মানও দিয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম লাল কার্ডটাও দেখিয়েছিলেন এক পুরুষ

ফুটবলারকে। সেই ঘটনা বলেন আর হাসেন জয়া, ‘আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচের খেলায় একটা ছেলে মারাত্মক ফাউল করে। ওকে লাল কার্ড দেখালাম। ও তো হতবাক হয়ে গেছে! ভাবতেই পারেনি আমি ওকে লাল কার্ড দেখাব। একটু রাগও করেছিল। খেলা শেষ করে আমার কাছে এসে ঘটনা বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়। পরে আমি রাতে তাকে বটতলায় নিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়ালাম।’

বাবা-মাও খুব উৎসাহ দিতেন তাঁদের বড় মেয়েকে। জয়ার বাবা সঞ্জীবন চাকমা ছিলেন কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কর্মকর্তা। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। আর মা মালতি চাকমা রাঙামাটিতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। জয়া বলেন, ‘বাবা একসময় ভলিবল খেলতেন। তাই আমাদের তিন বোনকে খেলাধুলার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। এক বোন বেতারে উপস্থাপনা করেন। আরেক বোন কলেজে পড়ার পাশাপাশি কারাতে খেলেন।’ জয়া চাকমার এই পর্যায়ে ওঠে আসার গল্পটা একটু অন্যরকম। আগের দুই বার পরীক্ষা দিয়েও ফল অনুকূলে আসেনি। এতেও দমে যাননি রাঙামাটির সাবেক এই খেলোয়াড়। নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে গেছেন। পণ করেছিলেন ফিফা রেফারি হওয়ার। সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে গেছেন। এখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলার অপেক্ষা। ফিফা রেফারির ব্যাজ হাতে পেলেই এএফসির এলিট প্যানেলের জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন জয়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট