চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার চোখে শরৎ

ছন্দা দাশ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

বর্ষা বিদায় নিয়েছে তার জলভার নিয়ে। এসেছে শরৎ। তবুও বর্ষার স্মৃতি এখনো একেবারে মুছে যায়নি প্রকৃতি থেকে। এখন ভরা ভাদর। তাই এই রোদ, এই ছায়া। তার মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে বৃষ্টির উপস্থিতি। বাংলার ঋতু বৈচির্ত্র্যের মধ্যে শরৎ আসে বাঙালির জনমানসে রূপ বৈচিত্রের ডালি নিয়ে। নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেলা, নদীর পাড়ে কাশের বনের হাতছানি, শিউলির গন্ধ, বাতাসে যেন শারদীয় আহ্বান। শরৎ আসলেই যেন মনে হয় ঢাকের আওয়াজ। মা আসছে।

পৃথিবী বদলাচ্ছে বদলে যাচ্ছে মানুষ, মানুষের জীবন যাত্রা, তাদের মানসিকতা। এমনকি পুজোর প্রতিমা থেকে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা। বাঙালি জীবনে পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রকট। একটা সময়ে প্রত্যেক ধর্মের, প্রত্যেক জাতির, প্রত্যেক অঞ্চলের, প্রত্যেক সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। আজ সে যেন হারিয়ে মিলেমিশে অন্য এক কৃষ্টির উদ্ভব হয়েছে। সে ভালো কি মন্দ তা আজ থাক। কিন্তু এর পরেও যেন মানুষে মানুষে দুরত্বটা যেন বাড়ছে।

আমাদের ছেলেবেলায় শরতের যে রূপ ও তার প্রভাব এখন আর তেমনটি নেই। সেই খোলা আকাশ, উদার মাঠ, সেই কাশের বন, নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা, কিশোরদের ডাংগুলি খেলা, ঘুড়ি উড়ানো সে এখন আর দেখা যায় না। সেদিনের সেসব কথা আজকের প্রজন্ম কিছুই দেখেনি, বোঝেও না। ওদের কোন আগ্রহও নেই। ওদের শরৎ ইন্টারনেটে। একটা লাইক দিয়ে শেষ। ঋতু বৈচির্ত্র্যের এই ছোঁয়া আমাদের দিয়েছে ভাবনার গভীরতা, সৃষ্টির আনন্দ। এই প্রজন্ম তা থেকে বঞ্চিত বলেই ওদের মধ্যে গভীরতা নেই। সৃষ্টিশীলতা নেই ওদের মধ্যে। তাই আজ আর জন্ম নেয় না একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন নজরুল বা জীবনানন্দ।
সাহিত্যেও এ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। প্রযুক্তির কি শক্তিশালী প্রভাব। ডিজিটাল যুগে জড় বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষও যেন হয়ে উঠেছে জড়। একে বলা যায় মানুষ নামের যন্ত্র। অবশ্য মানুষ কেন প্রকৃতিতেও তার প্রভাব পড়েছে সম্যকভাবে। তাই কোন ঋতুতেই দেখি না তার নিজস্ব প্রভাব। কেমন যেন বৈরী আচরণ। এখন বছর জুড়ে গ্রীষ্মের মাতম। পৃথিবী পৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়ছে নানাবিধ কারণে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে, বনাঞ্চল নিধন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় আমরা আমাদের দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলে যে আনন্দ, গৌরব অনুভব করতাম তার দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো।

ঋতু বদলের পরিক্রমায় আজও তবু শরৎ আসে তার স্বরূপে, আলো ছায়ার মাধুরিতে। সবুজ হারা শহরের কংক্রিটের মস্ত বড় বড় দালানের পাশ দিয়ে ঘাসহীন পীচঢালা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যখন দেখি একটুকরো সাদা মেঘ আজ অনন্যতায় ঘিরে আছে তখন মনে হয়,“শরতে তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী”

শরতের রূপ মনে আনে আনন্দধারা। প্রকৃতিতে তার প্রভাব থাক বা নাই থাক। শরতের যেসব উৎসব সে এখনো বাঙালি জীবনের অনুসঙ্গ। তাইতো শরৎ এলেই শুরু হয় প্রতিমা বানানোর তোড়জোড়। দোকান, শপিং মলগুলোতে নতুন সাজ নতুন কাপড়ের সমারোহ। বাঙালি তাদের দুঃখ, বিষাদ সরিয়ে মেতে উঠে শারদীয় দুর্গোৎসবে। এও শরতের আলাদা আকর্ষণ।
মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে পারস্পরিক এক বাঁধন। নিজের জীবনের সাথে যখন তারা হয় ক্লান্ত তখন একটু শান্তির আশায় খোঁজে প্রকৃতির আশ্রয়। প্রকৃতিও তাকে নিরাশ করে না। তার অরূপ রূপের মাধুর্য দিয়ে গড়ে তোলে অনন্যতা।
শরতের আর এক অনুষঙ্গ শিউলি। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখতাম গাছের নীচে ঝরা শিউলির দল। চোখ ফেরানো আর হয় না। মুগ্ধ চোখের তারায় আমার অন্য পৃথিবী। সে স্মৃতি ভাস্বর হয়ে আছে চিরদিনের জন্য। সাজি ভরা শিউলির ডালি নিয়ে হিম ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে কতদিন নিজেকে মনে হয়েছে এ কোথায় এলাম? আজোও শরৎ আসে শহরের বুকে ছাদের কোনায় টবে লাগানো শিউলি ফুলে। সে বড় কৃত্রিম। হাইব্রিড গাছের গন্ধহারা ফুল। আমাদের আজকের কৃত্রিম জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে। তবুও শরত আসলেই বলতে ইচ্ছে করে
“এই শরতে বুকের মাঝে
প্রাণে আমার কি গান বাজে
মন হারাবার দিন এসেছে
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে।
আলো ছায়ার পরশ মেখে
কোন ছবি যে আঁকে।”

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট