চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

নারীর জীবনে ফেসবুকের প্রভাব!

ছন্দা দাশ

২৮ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

নারীরা কি সত্যিই নিরাপদ? সেই কবে থেকে শুনে আসছি অসহায় নারী জীবনের কথা। যুগে যুগে, কালে-কালে নারীর অসহায় জীবনের কথা-তাদের সংগ্রাম, তাদের সুখ-দুঃখের চালচিত্র কতভাবে যে প্রকাশ পেয়েছে এবং তার জন্য পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সর্বোতভাবে আজও কি তার সমাধান বা ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে? না, হয়নি। একেবারে যে হয়নি তা বলবো না। কিন্তু, দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি নারী নির্যাতন আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। শুধু তার রূপ বদলে যাচ্ছে। একূল ভাঙে তো ওকূল গড়ি। কিন্তু সেকূলও দেখি ভাঙনের পথে। তখন আবার অন্য কূলের সন্ধানে দিশেহারা হয়। নারী নির্যাতনের অনেক কারণের মধ্যে প্রধান একটি কারণ অর্থনৈতিক একটা কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ভাবা হত বা বলা হত যদি নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয় তবে তার নির্যাতনের হার হ্রাস হবে। সত্যিই কি হয়? নাহ্ তা হচ্ছে না। আর কেউ যদি বলে হয় তবে তা বোধহয় গুটিকয়েক নারীর ভাগ্যে জোটে। আমি নিজেই দেখেছি বিশ^বিদ্যালয় ঘুরে আসা নারী কর্মজীবি হয়েও তার স্বাধীনতা নেই নিজের বেতনের টাকা নিজে ব্যয় করার। মাস শেষে তার বেতনের টাকা তুলে দিতে হয় স্বামীর হাতে অথবা সোজা জমা হয় স্বামীর একাউন্টে। যদি কেউ বলে থাকেন স্বামী যদি তার নিজের টাকা সংসারে ব্যয় করতে পারে তবে স্ত্রী কেন দেবে না? সংসার তো দুজনেরই। কথা সেটা নয়। যদি সে কোন পরিকল্পনা দু’জনের যৌথ প্রয়াসে হয় সেখানে তৃতীয় পক্ষের কথা বলার অবকাশ নেই। কিন্তু যে স্ত্রীর স্বাধীনতাই নেই নিজের উপার্জিত অর্থের ইচ্ছেমত খরচ করার সেখানেই থাকে আপত্তি। এসব নিয়ে অনেকবার অনেকে আলোচনা করেছেন। আমার আজকের লেখাও তা নিয়ে নয়। যা আমাকে ভাবিয়েছে, বিস্মিত করেছে, দুঃখী করেছে তার রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। ঈশ^রকে ডেকে বলেছি, হা ঈশ^র তুমি সৃষ্টিই যদি করলে প্রভু তবে তাকে কেন দিলে না অধিকার? আজ আমি আমার দেখা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী একজন নারীর জীবন নিয়ে লিখছি। এমন হয়তো আরও কত নারীর জীবন চোখের জলে কাটছে অসহায়, নিরাপত্তাহীন অবস্থা নিয়ে কে তার খবর রাখে? আমি যার কথা বলছি তাঁর নাম লায়লা রহমান। একজন স্কুল শিক্ষয়িত্রী। মাঝ বয়সী। সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্বচ্ছল। দুই সন্তানের জননী। স্বামীও ব্যাংকে কর্মরত অফিসার। গাড়ি বাড়ি দুইই তাদের আছে। আপাত দৃষ্টিতে কোন ফাঁক নেই। কিন্তু ফাঁক সে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, তা একদিন ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করবে তা বলাই বাহুল্য। শায়লা স্কুলে খুব জনপ্রিয় একজন শিক্ষিকা। রুচিশীল, মার্জিত, ভদ্র এবং দক্ষ তাঁর শিক্ষাদান। তাই স্কুলে শিক্ষয়িত্রী থেকে ছাত্রীমহলে সবার কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। স্কুলে শায়লা কখনো খুব বেশি সাজ, প্রসাধন, অলংকার পরে আসতে কেউ দেখেনি। এক্ষেত্রেও তাঁর রুচির ছাপ দেখা যেত। কিন্তু কিছুদিন ধরে হঠাৎ তার আগের সেই রুচির ধারা যেন বদলে যাচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেও কেউ কিছু বলছে না। তার পোশাক-আশাক যেমন পাল্টে যাচ্ছে তেমনি প্রসাধনেও যেন উৎকট বাহুল্য প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো আড়ালে অনেকেই এ নিয়ে কানাকানি করছে। কিন্তু শায়লা রহমান যেন কি এক উদাসীনতায় তার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। অনেকে আবার বলছেন শায়লা কি প্রেমে পড়েছে এই বয়সে? যা আমাদের পরিবেশে সচরাচর বলে থাকে। শায়লার সহকর্মী নাজমাও লক্ষ্য করে। সে শায়লার ঘনিষ্ঠ যদিও, তবুও কিছু বলে না। শুধু লক্ষ্য করে এত মেকআপের পরেও ওর চোখের নিচে দিনের পর দিন গভীর কালির দাগ। একদিন সে সুযোগ এসে গেল প্রশ্ন করার। বলা যায় শায়লাই ধরা দিল। কারণ নাজমাকে যখন বললো, আচ্ছা এই পোশাকে কি আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে? মানে বয়স কম দেখায়? আবার আরেকদিন নাজমাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ম্যাক্সী কাপড়-চোপড় কিনছে তখন নাজমা বললো হঠাৎ তার রুচির পরিবর্তন কেন? এই বয়সে তোর আরেকটু সচেতন হলে ভালো দেখায়। তখনই শায়লা যেন স্বাভাবিক চেতনা ফিরে পায়। সে নাজমার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে বলে, ‘আমি নাসিমকে ভালোবাসি। ওকে ধরে রাখতে চাই। সে আমার সন্তানের বাবা। এখন সে আর আমাকে ভালোবাসে না। আমার দিকে তাকায় না। বলেছে তোমাকে আমার আর ভালো লাগে না। আমি কি করবো?’ নাজমা ভীষণ অবাক হয়ে বলে তোর স্বামীর কি বয়স হয়নি? সে কি আগের মতো আছে? তার মতো তোরও কি মনের পরিবর্তন আসতে পারে না? শায়লা কাঁদতে কাঁদতে বলে আমি ওসব জানি না। আমি তো নাসিমকে ছাড়া কিছু ভাবি না। এই নিয়ে সংসারে আমার নিত্য অশান্তি। আমি কিছু বললেই সে জিনিসপত্র ভাংচুড় করে। অন্য ঘরে দরজা লাগিয়ে মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। হয়তো কারো সাথে চ্যাট করে। ছেলেমেয়েরাও আমার উপর বিরক্ত। বলে তোমাদের জন্য আমাদেরও অশান্তি। ঘরে লেখাপড়া করার পরিবেশ নেই। নাজমা বলে, তুই ছেলেমেয়েদের বোঝা! এই অশান্তি তো তুই সৃষ্টি করিস নি? কিংবা নাসিম সাহেবকে বল। ছেলেমেয়েদের সে তোদের জন্য ক্ষতি হচ্ছে। শায়লা বলে, তুই কি ভেবেছিস বলিনি। আসলে ও ফেসবুকে কোন মহিলার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তাই আমাকে আর তার ভালো লাগছে না। নাজমা বলে, ছেলেমেয়েরা জানে? চোখ মুছতে মুছতে শায়লা বলে, কেন জানবে না। ওরা সব বোঝে। কিন্তু ওরা বলে আমরা কি করবো? আমরা আব্বার উপর নির্ভরশীল। এখন আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। প্রতিবাদ করলে আব্বা যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায় আমাদের কি হবে? তখন আমি বলেছিলাম তবে তোরা আব্বার কাছে থাক, আমিই আলাদা হয়ে অন্য কোথাও থাকি। এতেও ওদের আপত্তি। ওরা বলে তুমি চলে গেলে আমাদের কি হবে? ঠিকমতো পড়াশুনাই তো করতে পারবো না। আমার হয়েছে শঁখের করাত। এদিকেও না ওদিকেও না। অথচ দেখ এই ছেলেমেয়েরা মানুষ হলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে এক মুহূর্তও দেরী করবে না। বাধ্য হয়ে নাসিমের পছন্দমত হবার নিস্ফল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নাজমার মুখে আর কোন প্রশ্ন নেই। সে ভাবছে যুগের কত পরিবর্তন? শায়লা সুন্দরী, শিক্ষিতা, কর্মজীবী হয়েও পারছে না পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করতে। অথচ দিনের পর দিন এইভাবে জীবন চালানো এক দুঃসহ অবস্থা। শেষ পর্যন্ত জীবন তাকে কি দেবে? নাসিম সাহেবের মতো এমন পুরুষগুলোর সংখ্যা বহু। বহু নারী সব জেনেও নীরবে মুখে সুখীভাব নিয়ে সংসার করে যাচ্ছে। এও নারী নির্যাতনের আরেক উদাহরণ। এই ফেসবুকের জন্য আজ অসংখ্য পরিবারে নেমে এসেছে অশান্তির করাল ছায়া। এমনকি অনেক পরিবার ভেঙেও গেছে। অনেক নারী হয়েছে নির্যাতনের শিকার। তাই বলে কি ফেসবুক শুধু খারাপই করছে? তা না এর ভালো দিকও অনেক। আসলে মানুষ কিভাবে কি কাজে ব্যবহার করছে তা তার উপর নির্ভর করছে ভালো-মন্দ। প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুটো দিক থাকে। আমাদের উচিৎ এর খারাপ দিকগুলো উপেক্ষা করে ভালো দিকগুলোর ব্যবহারে সচেতন থাকা। আর তা যদি না পারেন তবে তার ব্যবহার বন্ধ রাখাই সমীচিন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট