চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নারীর ক্ষমতায়ন ও আগামীর উন্নত বাংলাদেশ

জেসমিন আরা বেগম

৯ মার্চ, ২০২৩ | ২:০৯ অপরাহ্ণ

হাজারো বাঁধা নিষেধের দেয়াল ভেঙে, অপমান ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিপীড়ণ নির্যাতনকে তুচ্ছ করে নারীরা অদম্য শক্তিতে এগিয়ে চলেছে। ৫০ বছর আগের সেই প্রান্তিক-অক্ষম-অবলা- অশিক্ষিত-পরনির্ভরশীল- লাজুক এবং অন্ধকারে ডুবে থাকা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তকমা ছুঁড়ে ফেলে অনেকাংশেই নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মূলধারায়। আপনশক্তিতে বলীয়ান নারী নিজে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণ রেখেছে নিজের সক্ষমতার।

 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এ দেশের নারী জাগরণে সাড়া পড়েছিল সাধারণত শিক্ষা গ্রহণকে কেন্দ্র করে। এছাড়া ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নারী তার অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বাধীনতা লাভ করে। এ স্বাধীনতাযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অসামান্য অবদান রাখে। যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান এবং স্বামী ও সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে আমাদের মায়েরা এক বিশাল দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছেন। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গসমতা অর্জন করেছে। এমনকি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও আমাদের এই সাফল্য রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ মিলিয়ন। এদের মধ্যে ৯৭.৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, যাদের ৫০.৯ শতাংশ আবার মেয়েশিক্ষার্থী। আর মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ হার ৫৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায় মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নতির দিকে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা যদিও ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারাও তা স্বীকৃত। কিন্তু প্রায় ৫০ বছরেও তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি পুরোপুরিভাবে।

 

সমাজে এখনো নারীপুরুষ মজুরিবৈষম্য বিদ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও ক্রমবর্ধমান। এখনো পথেঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, গৃহে নারীরা নিরাপত্তাহীন। সমাজে বহুযুগের পুরনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এখনো প্রবল দাপটে রাজত্ব করে চলছে। যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ এবং যৌনহয়রানির মত ঘটনা বাড়ছে। নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকায়, নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যা-শিশুদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। এদিকে, বাল্যবিবাহের ফলে নারীর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে। নারীর প্রজননস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। মাতৃমৃত্যু, নবজাতকমৃত্যু, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের একটি কঠিন দুষ্টচক্র তৈরি হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নারীর জন্য দরকার নয়, একটা সমৃদ্ধ সুখীসমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দরকার। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে কখনোই সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য নীতি-নির্ধারণীপর্যায়ে যে কোন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনায় নারীর যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের মোট কর্মজীবী নাগরিকের প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী। শ্রমজীবী নারীর সিংহভাগ তৈরি পোশাকখাতে নিয়োজিত। এ ছাড়া বড় একটি অংশ নিয়োজিত আছে কৃষিখাতেও। গ্রামীণ কৃষিকাজের প্রায় ৪৬ শতাংশই করছেন নারীরা। শুধু কৃষিখাত নয়, গ্রামীণ পরিবেশে নারীরা উদ্যোক্তার ভূমিকা নিতেও শুরু করেছেন।  সমাজের সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জন করতে হলে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগ, শিক্ষাগত অর্জন, স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকা, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এই চারটি সূচকের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু সামনে আরো অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থার আরো উন্নয়ন করার জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। পশ্চাৎপদ ধ্যানধারনা ত্যাগ করে  সমাজকে ন্যায্যতা, যুক্তি আর জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। সর্বত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা র্নির্মূল করে নারীকে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতার যে নিশ্চয়তা প্রদান করেছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেজন্য সরকারসহ বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে পরিবার ও সমাজে নারীর সম্মানজনক অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। কবির ভাষায় বলতে গেলে- ‘কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’ আমাদের উচিত কাজী নজরুল ইসলামের অমর বাণী কাজে লাগিয়ে হাতে হাতে কাজ করা। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে শিক্ষায় নারীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করাসহ রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ প্রদান করে আসছেন।

 

আজ আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী থেকে শুরু করে প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম নারী পর্বতারোহী, বিজিএমইএ প্রথম নারী সভাপতি, প্রথম মেজর, প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার জানান দিয়েছে। এমনকি খেলাধুলার জগতেও নারীরা বিশ্বদরবারে এগিয়ে যাচ্ছে সমহিমায়। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। যেভাবে নারীরা তাদের মেধা, শ্রম, সাহসিকতা, শিক্ষা ও নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছে সেই একইভাবে আমাদের যুবসমাজের উচিত হাতে হাত মিলিয়ে তাদের সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা দেশকে চরম উন্নতির পথে ধাবিত করা।

 

নারীশিক্ষা ও নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। নারীকে তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর কাজকে ছোট করে দেখা চলবে না। নারীর ক্ষমতায়নে নারীকেই সবার প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। নিজেরা সচেতন না হলে, নিজের উন্নয়ন নিজে না ভাবলে ক্ষমতায়ন অসম্ভব। তাই নারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একান্ত অপরিহার্য।

 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। নারীর চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নে আমাদের এখনও অনেক পথ যেতে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সামনে যে রূপকল্প উপহার দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের হারার কোনো সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তির পাশাপাশি আমরা নারীমুক্তি; সর্বোপরি মানবমুক্তি ঘটানোর লড়াইয়ের জন্য এখন পুরোপুরি তৈরি। আগামীর উন্নত, সমৃদ্ধি বাংলাদেশ বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অংশীদার হবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: জেসমিন আরা বেগম সহকারী জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট