চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম ‘প্রথম মুখ’ ক্লডেট

মরিয়ম বেগম

৩ মে, ২০১৯ | ৫:১৩ অপরাহ্ণ

মাসখানেক ধরে স্কুলে পড়ানো হচ্ছে আফ্রো-মার্কিনদের ইতিহাস। শ্বেতাঙ্গদের হাতে কালো মানুষের নিগ্রহের কাহিনি। মাথার ভিতর ঘুরত সেই সব কথাই। তাই স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন শ্বেতাঙ্গ সহযাত্রীকে আসন ছেড়ে দিতে বললেন বাসের কন্ডাক্টর, বেঁকে বসেছিল বছর পনেরোর কিশোরী। পুলিশ এসে গ্রেফতার করে তাকে। রোজা পার্কসের বাস আন্দোলনের ন’মাস আগে প্রতিবাদ জানানো কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীটির নাম ক্লডেট কলভিন। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নাগরিক অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের অন্যতম ‘প্রথম’ মুখ, এখন অশীতিপর, সেই ক্লডেটকে রবিবার সম্মান জানাল নিউ ইয়র্কের একটি ইহুদি সংগঠন।
১৯৫৫-র মার্চ। অ্যালাবামার মন্টগোমারিতে স্কুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল কিশোরী ক্লডেট। তারা চার জনে বসেছিল বাসের পিছনের দিকের সিটে। তখনকার দিনে অ্যালাবামা প্রদেশে বাসের সামনের দিকের আসন শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ ছিল পিছনের কয়েকটা আসন, আর দাঁড়ানোর জন্য বাসের একদম পিছনের অংশটি।
সে-দিন পিছনের দিকের আসনেই বসে ছিল ক্লডেটরা। গোল বাঁধে বাসে একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণী উঠতেই। কন্ডাক্টর ক্লডেটদের উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। তিন বন্ধু উঠে পিছনে চলে গেলেও জানলার ধারের সিট ছেড়ে ওঠেননি ক্লডেট। সটান কন্ডাক্টরকে বলে দেন, ‘আমি তো কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত আসনেই বসেছি। তা হলে উঠব কেন?’ তিনটি আসন খালি থাকলেও বসতে পারেননি শ্বেতাঙ্গিনী। কারণ, তখনকার অ্যালাবামার আইনে কালো মানুষেরা সাদাদের পাশেই বসতে পারতেন না!

ক্লডেটের একরোখামি অবশ্যই ভাল চোখে দেখেননি কন্ডাক্টর। দু’-একটা স্টপ পরেই রাস্তায় পুলিশ দেখে জানান ‘গন্ডগোলের’ কথা। পুলিশ বাসে উঠে প্রথমে ক্লডেটের কোলে রাখা বইগুলো টান মেরে ফেলে দেয়। তার পরে হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যায় তাকে। সেখান থেকে জেলে। পরের দিন ক্লডেটকে ছেড়ে দেওয়া হলেও অনির্দিষ্টকালের জন্য তাকে নজরবন্দি করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আজ নিউ ইয়র্কে ‘কংগ্রিগেশন কোল আমি’ নামে একটি ইহুদি সংগঠন সামাজিক সাম্য ও নীতি রক্ষায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকার জন্য ‘আলোর দিশারি’ সম্মান জানাল ক্লডেটকে। পুরস্কার মঞ্চ থেকে ক্লডেট বলেন, ‘‘সব কিশোর-কিশোরীকে বলছি- ভয় পাবে না। যেটা ঠিক মনে হয়, সেই পথেই এগিয়ে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই সেই মুহূর্তে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।’’ র্যাবাই শিরা মিলগ্রোমের কথায়, ‘‘সে-দিনের সেই মুহূর্তটা আমাদের দেশের ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছিল।’’
ক্লডেটের সেই বিদ্রোহের কয়েক মাস পরে, মন্টগোমারিতেই, ৫ ডিসেম্বর বাসের আসন ছাড়তে অস্বীকার করেন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী রোজা পার্কস। শুরু হয় মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন। যাতে যোগ দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রও। কৃষ্ণাঙ্গদের এভাবে একঘরে করে রাখা যায় কি না, তা-ই নিয়ে মামলা গড়ায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। ২০ ডিসেম্বর শীর্ষ আদালত রায় দেয়, অ্যালাবামার এই আসন ভাগ সংক্রান্ত আইন বৈষম্যমূলক এবং চলতে পারে না। ২১ ডিসেম্বর বাসের সামনের আসনে বসা রোজার ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যালাবামার সব কাগজের প্রথম পাতায়।
ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে যায় রোজার। অন্যদিকে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান ক্লডেট। একটি সাক্ষাৎকারে ক্লডেট নিজেই বলেছিলেন, ‘‘তার একটা কারণ অবশ্যই, সেই সময়ে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলাম। তখনও বিয়ে হয়নি। আন্দোলনকারীরা হয়তো ভেবেছিলেন, আমাকে বিদ্রোহের মুখ করলে আমার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থা নিয়েই বেশি আলোচনা হবে।’’ তবে সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানির সময়ে ক্লডেটকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। মার্চ মাসের সেই দিনটাতে কী হয়েছিল, তা বিচারপতিদের জানাতে দ্বিধা করেনি কিশোরী। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘‘কালো ক্রীতদাসদের কথা ইতিহাস বইয়ে পড়েছি। পড়েছি হ্যারিয়েট টাবম্যান এবং সোজোর্নার ট্রুথের মতো বিদ্রোহীদের কথাও। সে-দিন কন্ডাক্টরের অন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন তাঁরাই।’’ ক্লডেটের কথায়, ‘‘সে-দিন জেল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, বাবা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে। প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বললেন, কু ক্লাক্স ক্ল্যানের মতো শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা বাড়িতে হামলা চালাতে পারে, তাই এই সতর্কতা। বুঝলাম, লড়াই সবে শুরু। আরও অনেক পথ চলা বাকি।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট