আজ আমার বন্ধুর বিয়ে।পৃথিবীটা যে ভালো মানুষদের জন্যে খুব একটা ভালো না বরং বেশ কঠিন, এ বন্ধুটা তার প্রমাণ। সেজন্যেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই মেয়েটা একটা ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছিলো যে পৃথিবীর বাকি অল্প সংখ্যক ভালো মানুষদের ওপর থেকেও তার বিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছিল।
বন্ধুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্কুল, কলেজ, বন্ধুরা সব ঢাকায়। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় মেয়েটা চান্স পেলো সিলেটের একটা ইউনিভার্সিটিতে। প্রথমে ভাবল কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ঢাকায়ই থেকে যাবে। তারপর বাকি সব বন্ধুদের নামিদামি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে দেখে মত বদলালো। চলে গেলো সিলেটে।
মেয়েটা ভারী শান্ত আর চুপচাপ। সহজে নিজের খোলসের বাইরে বেরোতে পারে না। ক্লাস সেরে চুপচাপ হলে চলে যায়। ক্লাসের অনেকগুলো গ্রুপ হয়েছে। কিন্তু কোনটার সাথেই তার তেমন যোগ নেই।এমন একা থাকার সময়েই তার সাথে অনলাইনে পরিচয় হল দেশের আরেক প্রান্তের আরেক ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা ছেলের। আস্তে আস্তে রোজ কথা, কথা থেকে প্রেম। তখনো কেউ কাউকে সামনাসামনি দেখেনি। কারণ ছেলেটার নানারকম পরীক্ষা, ল্যাব লেগেই থাকে। আমার বন্ধু বারবার প্ল্যান বানায় আর সেটা পিছিয়ে যায়।
এক পহেলা বৈশাখে দুজন ঠিক করে তাদের দেখা হবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলায়। মেয়েটা শখ করে শাড়ি কেনে, সাথে ম্যাচিং কানের দুল।সেদিন পরবে বলে লাল টুকটুকে কাঁচের চুড়ি কিনে দিই ওকে টিএসসির এক খালার কাছ থেকে। সাইজ ঠিক করার সময় ওর হাতে যত্ন করে চুড়ি পরিয়ে দিতে দিতে ওর লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে খালা হাসে।
আমার লাজুক বন্ধুটা অনেক শখ করে শাড়ি পরে সেদিন। ক্যাম্পাসে চলে আসে সকাল সকাল। ৯টায় দেখা হবার কথা ওদের। মহা হৈচৈ ক্যাম্পাসে সেদিন। লোকে ভুভুজেলা কিনে বাজাচ্ছে অবিরাম। ছবি তুলছে হলের সামনে, টিএসসিতে, চারুকলার কোণায় কোণায়।
এর মাঝে নতুন শাড়ি পরতে শেখা, নরম সরম একটা মেয়ে অপেক্ষায় আছে গত আট মাস ধরে যাকে ভালোবেসে এসেছে, তার। সময় গড়ায়। দশটা বাজে। ঢাকার রাস্তায় সেদিন জ্যাম খুব। তাই বোধহয় দেরি হচ্ছে, ভাবে বন্ধুটা। ফোন দেয় ছেলেটাকে। ধরতেই কেটে যায় কলটা। বেশ কবার। ধুর ছাই, কি অবস্থা আজ নেটওয়ার্কের!
টেক্সট করে সে ছেলেটাকে। কোন জবাব আসে না ও প্রান্ত থেকে। আশপাশের সবার দল বেঁধে হইচই, প্রেমিক-প্রেমিকাদের হাসিমুখ, ফুল বিক্রেতাদের হাঁকডাক সবকিছুর মাঝে নিজেকে হঠাৎ খুব বেমানান লাগতে লাগলো তার। সাড়ে বারোটা পর্যন্ত অসংখ্য টেক্সট আর ফোন দিয়েও আর ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করতে পারল না আমার বন্ধুটা…
লজ্জায়, অপমানে নুয়ে গিয়ে সে ফোন দিলো আমাকে। কি করবে সে এখন? ছেলেটার আসলেই কোন সমস্যা হয়েছে নাকি ওকে দেখে পছন্দ হয়নি বলে এসে কথা না বলে চলে গেছে? ওর গায়ের রঙটা ময়লা বলে এ শাড়িতে যে ওকে মানাচ্ছে না এ কারণেই বোধহয় ছেলেটা ওকে পছন্দ করেনি। এসে ওকে দেখে চুপচাপ চলে গেছে!
নাহলে কাল রাতেও যে বলল আজ দেখা হবে সে কেমন করে গায়েব হয়ে গেলো? পৃথিবীতে কত রকমের নিষ্ঠুর মানুষ আছে, আমি নিজেও তখনো জানতাম না। আমরা দুজনেই খুব করে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম ছেলেটার কোন বিপদ হয়েছে বলেই সে আসতে পারেনি।
অমন একটা আলো ঝলমলে দিনে, বাংলা নতুন বছরের উদযাপনের আনন্দের মাঝে শ্যামলা গায়ের রঙের মিষ্টি মেয়েটা নিজেকে নিয়ে মরমে মরে গেলো…সারাজীবন ধরে যে বিশ্বাস করে এসেছে সে দেখতে সুন্দর না, সে বিশ্বাস আরো পাকাপোক্ত হল।
ছেলেটা যোগাযোগ করবে, অন্তত জানাবে কেন আসেনি এ অপেক্ষায় অনেকদিন থেকেছে মেয়েটা। বারবার ফোন করেছে। সে নাম্বার থেকে আর কোনদিন কল আসেনি। ফোন করলে কল ফরওয়ার্ড হয়ে গিয়েছে একটা বন্ধ নাম্বারে। অনেকদিন লেগেছে মেয়েটার এ কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে। কিংবা হয়তো কখনই বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেকেন্ড ইয়ারের ঘটনা এটা।এরপর পুরো ক্যাম্পাস লাইফে আর কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি সে।
তারপর একদিন দেশ ছেড়েছে মাস্টার্স করবে বলে। তার যতটা না পড়তে, তার চেয়ে বেশি ছিল দেশে থাকবে না বলে। বিয়ে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল তার। মেয়ে দেখা, গায়ের রঙ খারাপ বলে নানারকম অজুহাতে বিয়েতে ছেলেপক্ষের রাজি না হওয়া পার করে একদিন মেয়েটা সাদাদের দেশে চলে গেলো। ও দেশে সাদারা ছাড়া সবার গায়ের রঙ ময়লা। এই ভালো।
খুঁজেপেতে আশপাশে বাংলাদেশী কম এমন এলাকায় বাসা নিল সে। এখানে এসেও দাওয়াতে গিয়ে কেন বিয়ে হচ্ছে না সে গল্পে অংশ নেবার আগ্রহ নেই তার। অমন করে একা জীবন কাটাতে কাটাতে মাস্টার্স শেষ হয় ওর। চমৎকার একটা চাকরিও হয়ে যায়।নিজের মতো ঘুরে বেড়ায় সে। একাই দেশটা ঘুরে দেখে। সাহস করে ড্রাইভিংটাও শিখে ফেলে ঢাকার রাস্তায় স্টিয়ারিং ধরতে ভয় পাওয়া মেয়েটা।
ঘুরতে গিয়েই একদিন ওর পরিচয় হয় মিশরের এক মহা রুপবান যুবকের সাথে। যুবক আর সে একই ট্রেইলে হাইকিং করতে গিয়েছে। একটা ভিউপয়েন্টে মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্তের ছবি তুলছে সে। অমন সময় দেখল হাসিমুখে এগিয়ে আসা সুন্দর ছেলেটাকে।
কি সুন্দর গায়ের রঙ তার। সাদাদের মতো সাদা না, কিন্তু দেশি ফরসাদের চেয়ে অনেক ফেয়ার। চাপ দাড়ি, মাথা ভর্তি চুলের ছেলেটাকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো সে। ছেলেটার বলা ‘হাই’ এর জবাব দিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটা কয়েকটা ছবি তুলে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি ভারতীয়?’ বন্ধু মাথা নাড়ল। কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। হাল ছাড়ল না ছেলেটা। ‘তবে কি শ্রীলংকান?’ বন্ধু জানে গায়ের রঙ ভালো হলে ছেলেটা শ্রীলংকান না ভেবে পাকিস্তানি ভাবতো। সে নিরস গলায় বলে, ‘বাংলাদেশি। তুমি?’
ছেলেটা ঝলমল করে হাসে। জানায় সে মিশরীয়। এদেশে এসেছে বছর পাঁচেক আগে। কথা বলবে না বলবে না করেও আস্তে আস্তে গল্প জমে যায় দুজনের। দুজনেই এসেছে নিজের দেশ ছেড়ে, ঘুরতে ভালবাসে দুজনেই। দুজনের জীবনেই আপাতত কেউ নেই। অল্প করে গল্প এগোয়।মেয়েটা ভুলেও তার তালা দেয়া হৃদয় খোলে না। কিন্তু বন্ধু হবার সুযোগটা দেয় ছেলেটাকে। পরের বেশ কটা ট্রিপে একসাথে যায় দুজন। ছেলেটা ফটোগ্রাফি ভালবাসে। সাবজেক্ট হিসেবে বন্ধুকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে বন্ধুর দেশি ‘ময়লা’ গায়ের রঙের মুখের দিকে।
বলে তোমার মাঝে মিশরীয় এক দেবীর ছায়া দেখি আমি। মুখ বাঁকায় আমার বন্ধু। এসব কথায় আর ভুলবে না সে। ছেলেটা জেনে অবাক হয় যে আমার বন্ধু জানে না সে কতটা সুন্দর। গুগল ঘেঁটে দেবীর ছবি বের করে দেখায়। অবাক হয়ে বন্ধু দেখে ছেলেটা মিথ্যা বলেনি। দেবীদের সব দেশে ফরসা হতে হয়না।
দিনে দিনে অল্প করে বন্ধুর বন্ধ হৃদয়ের দরজার চাবি খুঁজে নেয় যুবক। বন্ধু প্রায়ই তার আশংকার কথা জানায় আমাকে। অপেক্ষায় থাকে কবে যুবক পালিয়ে যাবে তার। নানাভাবে পুশ করে দেখে চলে যায় কিনা। তাকে অবাক করে দিয়ে যুবক থেকে যায়।
বন্ধুর গত জন্মদিনে তাকে সারপ্রাইজড করে প্রপোজ করে বসে যুবক। ভারী রোমান্টিক সে প্রপোজাল। অফিস থেকে বেরনো, ক্লান্ত এলোচুলে ঝুঁটি বাঁধা বন্ধুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে যুবকের হাতের ঝলমলে হীরার আংটিটার দিকে।
তার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না তার মতো একটা মেয়েকে এতো সুন্দর, দেখলে হার্টবিট মিস হয়ে যায় রকম হ্যান্ডসাম একটা ছেলে এভাবে বিয়ে করতে চাইছে! এ ছেলেকে তার সাথে দেখলে দেশের কেউ বিশ্বাস করবে না। দেশে এক আত্মীয়া তাকে বলেছিলো ওর যে চেহারা তাতে কোন সুপুরুষ যুবক ওকে বিয়ে করবে না। ওর জন্যে কোন বয়স্ক, বিপত্নীক লোকই জুটবে। সে লোকের চেহারা কেমন, মাথায় চুল আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো রূপবতী সে না!
সে বন্ধুর আজকে বিয়ে। বিয়েটা যদি এদেশে হতো, আমি যেমন করেই হোক, তার পাশে থাকতাম। তার হবু বরের হাতে তার হাত তুলে দিয়ে বাংলায় বলতাম, ‘ভাই, জিতসেন। আমার বন্ধুটা তার আঙ্গুলে আপনার পরিয়ে দেয়া হীরার চেয়ে কোন অংশে কম না।’বড়বেলার জীবনে আশপাশে খুব বেশি ফেয়ারিটেল সত্যি হতে দেখি না। কিন্তু আমার বন্ধুটা ঠিক তার জীবনের প্রিন্সকে পেয়ে গেছে। ভাগ্যিস সেই পহেলা বৈশাখে সে ছেলেটা আসেনি। ভাগ্যিস ওদের দেখা হয়নি কোনদিন। ভাগ্যিস আমার বন্ধুটা লোকের কথায় যার তার জন্যে স্যাটেল করে বসেনি।বন্ধু ভিডিও কলের ওপাশে বউ সাজে। জল ছলছল চোখে বলে, তবে তাই হোক। আমরা খিলখিলিয়ে হাসি…সেই ছোটবেলায় কি কারণে কিছু করার আগে আমরা এটা বলা শুরু করেছিলাম মনেও নেই…ট্রাডিশন রয়ে গেছে!
বউ সাজলে পৃথিবীর সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায়… আমার বন্ধুকে দেখে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না! সাদা জামদানিতে ওর শ্যামলা গায়ের রং আরো বেশি সুন্দর লাগছে! খুব অল্প কিছু বাস্তবতাই রুপকথার চেয়েও সুন্দর হয়। তারই একটার সাক্ষী হতে পেরে কি যে ভালো লাগছে আমার!
ওর হাসিমুখ দেখে হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটা কবিতা মনে পড়ে আমার।
’শোন মিলি।
দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকে
বিঁধে বারংবার।
তবুও নিশ্চিত জানি,একদিন হবে তোর
সোনার সংসার ।।
উঠোনে পড়বে এসে একফালি রোদ
তার পাশে শিশু গুটিকয়
তাহাদের ধুলোমাখা হাতে – ধরা দেবে
পৃথিবীর সকল বিস্ময়।’
আমি মনে মনে প্রার্থনা করি মেয়েটার সংসার সুখের হোক, সে সংসারে কোনদিন ভালোবাসার অভাব না হোক