দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর এক চ্যালেঞ্জ। ছাত্ররা রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে রাজপথে। এই উদ্যোগ সফল করতে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে সেটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু এই সময়ে না, গত ৫৩ বছরে দুর্নীতি শুধু বাড়ছেই। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কার করতে হবে। সেখানে এমন একজনকে বসাতে হবে, যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়তে হবে, যাতে করে দুর্নীতিবাজরা রেহাই না পান। এ কাজে অভিজ্ঞ এবং শতভাগ সৎ একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।
আপনাদের মনে করিয়ে দেই, ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩য়। স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতি যে শুরু, স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, সব ছাড়িয়ে গত ১৫ বছরে হলমার্ক কেলেঙ্কারি-বেসিক ব্যাংকে লুটপাট, ব্যাংকিং খাতের ধ্বংস, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, রূপপুরের বালিশকাণ্ড থেকে শুরু করে বিদেশে টাকা পাচার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর এক পিয়নই চারশ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। এতো বড় অপরাধীকে তিনি কী ধরেছেন? সাবেক আইজিপি বেনজির কিংবা ছাগলকাণ্ডের মতিউরের তো বিঘার পর বিঘা জমি, অসংখ্য ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট, দেশে-বিদেশে সম্পদ গড়েছেন, অথচ দুদক ধরলো না। এই দুদক পুষে কি লাভ?
আসলে দুদকে প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা প্রশাসনে থাকা আমলাদের দুর্নীতি ঢাকতেই ব্যস্ত থাকেন। এখন থেকে প্রেষণে এমন কর্মকর্তাকে আনতে হবে, যিনি অত্যন্ত সৎ, শুদ্ধ ও দুদকের আইন কানুনে দক্ষ।
আপনাদের মনে থাকার কথা, কক্সবাজারের ভয়াবহ দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় দুদকের সহকারী পরিচালক শরীফকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। আসলে দুদকের যে বিধিমালা ৫৪(২) বিধিটা বাতিল করা উচিত।
এ কারণেই দুদকের আইন বিধিসহ সিস্টেমের সংস্কার দরকার। দুদকের এমন ক্ষমতা দেওয়া দরকার যাতে, সবার দুর্নীতি ধরতে পারে। জেলায় জেলায় অফিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাংক, বিআরটিএ, পাসপোর্ট, এনআইডি, কাস্টমস, পুলিশ এবং ট্যাক্সসহ সব সার্ভারে তাদের এক্সেস থাকা উচিত।
তবে দুদকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো দুদক চেয়ারম্যানের। অতীতে দেখেছি, দুদকের চেয়ারম্যান বসানো হয়েছে, যিনি ক্ষমতাশালীদের দুর্নীতি দেখেন না। সরকারের সুনজরে রয়েছেন এমন কারো বিরুদ্ধে দুদক কখনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস করে নি। তারা চুনোপুটি নিয়েই ব্যস্ত এবং সরকারকে খুশি করতে নিবেদিত থাকেন। কাজেই এমন একজন সৎ ও যোগ্য লোক দরকার, যিনি দল বা শক্তির কাছে মাথা বিক্রি করবেন না।
দেশের বর্তমান সংস্কার বিবেচনায় দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী স্যারকে দুদকের চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব করছি। দুদকের মহাপরিচালক হিসেবে ২ বছর অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতি ধরতে শুরু করায় তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয় ক্ষমতাসীনরা। তাঁর আমলেই সবচেয়ে বেশি সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনিই দুদকের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এনফোর্সমেন্ট অভিযান শুরু করেছিলেন এবং মন্ত্রণালয়ে যেয়ে মন্ত্রী-সচিবদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিলেন। দুদকের হট লাইন ১০৬, ফরেনসিক ইউনিটের উদ্যোগ, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরার অভিযান পরিচালনা করেছেন। তাঁর ভয়ে সচিবালয়ে পদস্থ কর্মকর্তারা তটস্থ থাকতেন। সরকারি আমলাদের বেআইনি গাড়ি ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
মুনীর চৌধুরীকে যারা চেনেন না তাদের বলি, এদেশে বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা যখন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন বা হাল ছেড়ে দিয়েছেন মুনীর চৌধুরী তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বন্দর, ওয়াসা ও বন বিভাগের ৬০০ একরের বেশি বেদখল জমি ও নদী উদ্ধার করেছেন। আদায় করেছেন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জরিমানা ও রাজস্ব। দলবাজিকে না বলেছেন, মন্ত্রী-সচিবদের অন্যায় প্রভাব ও রক্ত চক্ষুকে পরোয়া করেননি। তবে একারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মুনীর চৌধুরী যা করেছেন, তা অবিস্মরণীয়।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সমুদ্র পরিবহনের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী পরিবারের মালিকানাধীন লঞ্চ (কোকো-২) আটক ও জরিমানা করেছিলেন। মন্ত্রী সাকা চৌধুরীর জাহাজ আটকসহ প্রায় ৭ হাজার দেশি বিদেশি জাহাজ আটক ও দন্ডিত করেছেন। এসব লড়াই করতে করতে শত্রু বানিয়েছেন ক্ষমতাশালীদের, বিপন্ন করেছেন জীবনকে এবং অসংখ্যবার বদলি হতে হয়েছে, চাকরি চলে যাবার উপক্রম হয়েছে, কিন্তু মুনীর চৌধুরী ভয় পাননি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার ভয়াবহ দুর্নীতি নিয়ে আমি একাধিক নিউজ করেছিলাম। মুনীর চৌধুরী এমডি পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমূল বদলে গিয়েছিল মিল্ক ভিটার চিত্র। সর্বপ্রথম লাভের মুখ দেখেছিলো এ প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে গিয়েছিলো, দুধের বিশুদ্ধতা ফিরে এসেছিলো, আধুনিকায়ন হয়েছিলো। দৈনিক ৮০ হাজার লিটার থেকে প্রায় ৪ লক্ষ লিটারে দুধ বিক্রি বেড়ে গিয়েছিলো। মিল্ক ভিটাকে বিশুদ্ধ দুধের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু মন্ত্রীর দুর্নীতির পথ বন্ধ করে দেয়ায় সরিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। বিদ্যুৎ খাতের বিশাল প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসিতে এসে তিনি বিদ্যুতের ১২০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অর্থ উদ্ধার করেছিলেন। এমপি মন্ত্রীর আত্মীয় কাউকে তিনি ছাড়েননি। মন্ত্রী নসরুল হামিদের রোষানলে পড়েও দমেননি। ডিপিডিসি‘র এমডি এ অর্থ উদ্ধারের জন্য তাঁকে জনপ্রশাসন পদক দেয়ার প্রস্তাব করলে তদানীন্তন মুখ্য সচিব তা প্রত্যাখান করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরে এসে তিনি সহস্রাধিক শিল্প কলকারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নদী ও জমি দখল রুদ্ধ করেন, আদায় করেন ১২৩ কোটি টাকা জরিমানা। সারাদেশে ৩ শতাধিক অবৈধ ইটভাটা ভেঙে নতুন প্রযুক্তি আনেন। বর্তমান আওয়ামী সরকারের অন্তত: অর্ধশত মন্ত্রী, এমপি‘র অবৈধ শিল্প প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ কিংবা জব্দ ও জরিমানা করেন। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের আক্রোশে পড়লে তাঁকে হঠাৎ শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। ‘হাসান মাহমুদকে’ দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন মুনীর চৌধুরী।
আফসোস আওয়ামী লীগ সরকার দুদক থেকে তাঁকে সরিয়ে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়। জাদুঘরে এসে এ প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এ প্রতিষ্ঠান এখন শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত। ১ টাকাও অডিট আপত্তি নেই।
মুনীর চৌধুরী এখনো দুদকের সৎ কর্মকর্তাদের জন্য অনন্য প্রেরণা। আমি বিশ্বাস করি, স্যার দুদকের চেয়ারম্যান হলে দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে আমরা অনেক এগিয়ে যাবো। আমি চাই দুদকের দায়িত্ব নিয়ে মুনীর চৌধুরী গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে যেসব নেতা, মন্ত্রী ও সচিব কে কীভাবে কতো টাকার দুর্নীতি করেছে, কোথায় কোথায় সম্পদ গড়েছে সেগুলো বের করবেন ও উদ্ধার করবেন। এরপর সব টাকা বাজেয়াপ্ত করবেন। পাশাপাশি তিনি দুদকের এমন একটা কাঠামো দাঁড় করাবেন, যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারে। মুনীর চৌধুরী নিজের স্বার্থকে কখনো দেখেননি। এমন লোক আমলাতন্ত্রে আছে কি ?
দেখেন আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়তে হলে রাজনীতি থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম সবাইকে ঠিক করতে হবে। নয়তো দু’দিন পর আবার যা তা হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর হলো। এবার তারুণ্যের হাত ধরে এই বাংলাদেশ ঠিক হোক।
আমি মনে করি ২-৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করার বদলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যার নেপথ্যে ছাত্ররা তাদের হাত ধরে আগামী ২-৩ বছরে আগে দেশটা ঠিক হোক। এরপর রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতা যাক। তার আগে না। কারণ ক্ষমতায় গেলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কী করে সেটা গত ৫৩ বছর ধরে দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। কাজেই ড. ইউনূসের সুরেই বলি, একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণেরা প্রস্তুত। আমরা সুযোগটি হারাতে চাই না।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট।
পূর্বকোণ/এসএ