সহিংস পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, আতংকগ্রস্ততা ও আসন্ন সময় নিয়ে অনশ্চিয়তা থেকে প্রাত্যহিক জীবনে ঘুমাতে না পারা, খাওয়া-দাওয়ার অনীহাসহ দৈনন্দিন কাজে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে না পারার মতো বহুমাত্রিক, জটিলতার জন্ম নিয়েছে।
ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানান ধরনের ডিজঅর্ডার তথা মানসিক জটিলতা। মানুষ হয়ে আছেন ‘ট্রমাটাইজড’। যার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব হলো- ‘ডিপ্রেশন’ ও ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)’ এর মতো মনোরোগীতে পরিণত হওয়া।
মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মতে বর্তমানে চলমান অশান্ত উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মাঝে যে মনোদৈহিক ও মনোসামাজিক বিপর্যয় নেমে এসেছে; তা তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। ফলোশ্রুতিতে বিনষ্ট হচ্ছে- তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও সৃজনশীলতা।
সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে- স্বতঃস্ফূর্ততা। যেহেতু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারছে না। তাই তাদের সৃজনশীলতা হচ্ছে বিঘ্নিত। এতে করে তাদের দৈনন্দিন কাজ-কর্মে নেমে আসছে আচরণিক বিক্ষিপ্ততা ও অস্বাভাবিকতা।
এমতাবস্থায় মুখোমুখি হওয়া অপরিচিত মুহূর্তগুলোর সাথে খাপ খাওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তথা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ হয়ে পড়ছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। করছেন এমন সকল আচরণ; যা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সামাজিকতা এবং মানবিকতার স্বপক্ষে যাচ্ছে না। আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি অতি উৎসাহী হয়ে মানুষ জড়িয়ে পড়ছেন নেতিবাচক কাজে। অংশগ্রহণ করছে অনৈতিক ও অগ্রহনযোগ্য ক্রিয়া-কর্মে। ভেঙে পড়ছে সামাজিক সুস্থিরতা। যা মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় মনোবৈকল্যতা হিসাবে চিহ্নিত।
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মানুষ করছেন অসামাজিক কাজ। যা নষ্ট করছে- সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য। সহনশীলতা হারিয়ে অনেকে হয়ে পড়ছেন অসহিষ্ণু করে ফেলছেন অমানবিক ও ধ্বংসাত্মক কাজ। আক্রমণ করছে বিরুদ্ধ মতের অপর রাজনৈতিক সংগঠনকর্মী, কার্যালয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মী ও থানাগুলোতে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিতিশীল পারিপার্শ্বিকতা। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে মনোবৈকল্য।
যা একটি ভঙ্গুর সমাজ কাঠামো গড়ে তুলছে। যেই সমাজ কাঠামো আমাদের কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং অপ্রত্যাশিত। আনুপূর্বিক এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে যে অশান্ত পরিস্থিতির দিকে আমার সমাজ বাস্তবতা চলে যাচ্ছে- যা একটি ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম দেবে।
যদিও ইতিবাচক আত্ম উপলব্ধির কারণে অনেকে লুটপাটের বস্তুগত সম্পদ ইতোমধ্যে দিচ্ছেন ফেরত। নতুন এই ইতিবাচক উপলব্ধিকে উপজীব্য করে প্রয়োজন ক্যাম্পেইন।
তাই আমাদের উচিৎ উল্লিখিত নেতিবাচক ও ইতিবাচক পরিস্থিতি সুসামঞ্জস্যতাপূর্ণ সামাজিকীকরণ খাতে প্রবাহিত করতে অনতিবিলম্বে মনোবৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য-সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা। তথা লক্ষ্য জনগোষ্ঠীভিত্তিক মনোস্বাস্থ্য পরিসেবা চালু করা। যাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানুষ তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া নেতিবাচক মনস্তত্ত্বকে ইতিবাচকভাবে গড়ে তুলে মনোবৈকল্যতা মুক্ত হবেন এবং করবেন ইতিবাচক ও মানবিক আচরণ।
পর্যায়ক্রমিক সেই মনোদৈহিক ও মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ইতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক সেবায় গড়ে তুলবে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমাজ পরিকাঠামো। সৃষ্টি হবে একটি মানবিক সমাজ। আর মানুষ হবেন প্রশান্ত মন ও মননের মানবিক বৃক্ষ।
যেই মানবিক বৃক্ষের মননশীল ও ইতিবাচক আচরণ নিশ্চিত করবে একটি সহনশীল ও সম্প্রীতির সামাজিক অবকাঠামো। যার জন্য প্রয়োজন মনোবৈজ্ঞানিক একটি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা কাঠামো। আর তা তখনই সম্ভব হবে; যখন নিশ্চিত করা হবে- মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রকে সহজলভ্য ও প্রশস্ত। যাতে করে মানুষ বাধাহীনভাবে গ্রহণ করতে পারে আচরণ বিজ্ঞানের এই পরিসেবা।
সামগ্রিক অবস্থা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে তাই নীতিনির্ধারকদের কৌশলগত বিবেচনার জন্য দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশে একটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি গড়ে তুলতে আমি নিম্নের কর্ম প্রস্তাবনাটি তুলে ধরছি।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস উল্লেখিত কর্ম প্রস্তাবনাটি গ্রহণ ও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে আমরা পাব একটি প্রশান্ত ও মানবিক সমাজ। মনস্তাত্ত্বিক জেকব লিভি মরিনো যাকে ব্যাখ্যা করেছেন “থেরাপিউটিক সোসাইটি” হিসাবে।
আশার বিষয় হচ্ছে- সম্প্রতি গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা হচ্ছেন মনোচিকিৎসক। যদিও তিনি ওষুধি চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তথাপিও আমি আশাবাদী তিনি জাতীয়ভাবে ওষুধবিহীন তথা সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপভিত্তিক মনোচিকিৎসা পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ‘জাতীয় মনো-বৈজ্ঞানিক সেবা পরিকাঠামো ও অবকাঠামো’ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।
কেননা প্রচলিত সাইকোথেরাপির পাশাপাশি ‘এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি’ অনুশীলনের মাধ্যমে স্বল্পসময় ও আর্থিক লগ্নিতে অধিক মানুষের জন্য মনো-সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ ‘এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি’ হচ্ছে একটি ‘দলীয় মনো-স্বাস্থ্য সেবা পরিকাঠামো’। যা বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক অনুশীলিত একটি মনোস্বাস্থ্যসেবা কর্মকৌশল।
অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসংখ্যার জনমিতি ও বয়সভিত্তিক বৈচিত্র্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের পরিসংখ্যান বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপিকে চলমান স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে অন্তর্ভুক্তকরণের যৌক্তিক ও কার্যকরী একটি কর্ম-প্রচেষ্টা হিসাবে পরিগণিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তাহলে ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা ‘কিশোর গ্যাং’ এর সদস্যদের তালিকাভূক্ত করে সংশোধনাগারের অবয়বে এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি ভিত্তিক সেবা যেমন সুনিশ্চিত করা যাবে; তেমনি তাদের একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক মনোবৃত্তিধর্মী জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি সংগঠিত সহিংসতায় দেখা গেছে যে ‘কিশোর গ্যাং’ খ্যাত এই জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল এবং এখনও আছে। সুবিধাবাদীরা তাদের ব্যাবহার করছে নিজস্ব চাহিদা পরিপূর্ণ করার নেতিবাচক অভিপ্রায়ে। অনুরুপভাবে মনোবৈকল্যতায় ভুগছেন এমন নাগরিকদের চিহ্নিত করে তাদের অংশগ্রহণে ‘এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি’ সেশন আয়োজনের মাধ্যমে আমরা পারি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইতিবাচক মনস্তত্ত্বের একটি দক্ষ ও কর্মক্ষম জনসম্পদ গড়ে তুলতে।
যেই জনসম্পদকে আমরা পাবো- গঠনমূলক কাজে এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তারা তাদের সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে রাখতে পারবে ইতিবাচক অবদান। যা এই ভঙ্গুর সমাজ-কাঠামোকে পুনর্গঠনে রাখবে জনহিতসী ভূমিকা।
কারণ ‘এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি’ হচ্ছে অভিব্যক্তিমূলক একটি মনস্তত্ত্ব মূল্যায়ন ও ইতিবাচক মনোভাব গঠনের কার্যকরী প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো- অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণশৈলী। এই শৈলী মানুষের অভিব্যক্তিকে স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে ইতিবাচক ও গঠনমূলক খাতে প্রবাহিত করতে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান নীতি নির্ধারক তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের কাছে বিনীত অনুরোধ- দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রস্তাবিত কর্ম কৌশল ‘এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি’ প্রদানের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগের পাশাপাশি লক্ষ্য জনগোষ্ঠীভিত্তিক সেবা প্রদানের জন্য স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। যাতে করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা চলমান সহিংস পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি গঠনমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথ হয় প্রশস্ত।
প্রস্তাবক: সাধারণ সম্পাদক, মেন্টাল হেলথ এডভোকেসি এসোসিয়েশন (এমএইচএএ)।
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ