প্রথমবার মার্কিন দেশে পা দিয়েই আমাদের প্রথম ‘আস্তানা’ ছিল শিকাগোর ‘QUALITY INN’ হোটেলে। এটা শিকাগো শহরের আর পাঁচটা মাঝারি মানের হোটেলের মতো। সেখানে দু’রাত কাটিয়ে এদেশের আদব-কায়দা আর শিষ্টাচারের নমুনা পেয়েছিলাম মাত্র। তারপর ওখানের কাজ মিটিয়ে এখন এসে উঠেছি মেয়ে-জামাইয়ের বাসস্থানে। আজকের লেখায় এখানকার বাসস্থানগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করবো।
বিদেশের বাড়ি-ঘর, জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা, আদব-কায়দা, প্রশাসন- এসব সম্পর্কে আমার আগ্ৰহ ছোটবেলা থেকেই। বই, পত্র-পত্রিকা কিংবা বিদেশে থাকা বন্ধু-বান্ধবের মুখে দু’চার কথা শুনে একটা অস্পষ্ট ধারণা হয়েছিল মাত্র। তাই এবার যখন নিজের চোখে এসব প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এলো, তখন সেটা চেটেপুটে নেবার সুযোগ ছাড়তে চাইনি। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, প্রবাসী বন্ধুরা তাদের বিদেশের বাড়ি-ঘর, জীবনযাপন কিংবা খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্ন এড়িয়ে চলে। যেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’- এমন একটা ভাব করে।
আমি যেখানে যেখানে থেকেছি, আমার দৃষ্টিতে যা পড়েছে, তারই বর্ণনা তুলে ধরবো এই লেখায়। সমগ্ৰ মার্কিন দেশে এমন ব্যবস্থা নাও হতে পারে। এখানে সব বাড়ির গঠন একইরকম। এলাকাভেদে বাড়ির গঠন আলাদারকমের হয়। তবে পাশাপাশি তৈরি বাড়িগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বড় বড় অক্ষরে প্রতিটি বাড়ির সামনে সংখ্যা লেখা। ঐ সংখ্যা সেই বাড়ির নম্বর নির্দেশ করে। প্রত্যেক বাড়ির সামনে কিছুটা ফাঁকা জমি। অবশ্যই জমিগুলো সবুজ ঘাসে ঢাকা। একটি বাড়ি থেকে অপর বাড়ির মাঝে আছে নির্দিষ্ট দূরত্ব। বাড়িগুলো কাঠের তৈরি এবং মাথার ছাদ এসবেস্টস জাতীয় জিনিস দিয়ে ঢাকা। বছরের বেশিরভাগ সময়ই ঠান্ডা এবং বরফ পড়া এরকম গঠনের কারণ। বাড়িগুলো দোতলা। মার্কিন দেশের বেশিরভাগ অংশে মাঝেমধ্যেই প্রবল ঝড় আছড়ে পড়ে। তাই এখানে অনেক বাড়ির মাটির তলায় একটা ‘বেসমেন্ট’ থাকে। এটা প্রবল ঝড়ের সময় বাড়ির বাসিন্দাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
এবার আসি বাড়ির ভেতরের অংশে। এখানে ঘরের প্রাচীর, মেঝে কিংবা ঘরের ছাদ, সিঁড়ি- সবই কাঠের। সেই ছাদের উপরের অংশ টিনের ছাউনি দিয়ে ঢাকা। ছাউনিগুলো খুব ঢালু। ওগুলো এমনভাবে লাগানো থাকে যে, ওর ওপর বরফ পড়লে তা সহজেই গড়িয়ে নিচে পড়ে। অনেক সময়ই টিনের ছাদ বরফে ঢেকে যায়। তারপর সূর্যকিরণ পড়লেই বরফ গলতে শুরু করে। একসময় তা জল হয়ে নিচে নেমে আসে। আমাদের দেশের মতন প্রত্যেক বাড়িতে পাখার দেখা এখানে মেলে না। বেশিরভাগ বাড়ি ‘সেন্ট্রাল এসি’। তবে পঞ্চাশটি বিশাল বিশাল রাজ্য নিয়ে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দেশটিতে ছয়টি টাইম জোন। নির্ভরতা (আবাসিক ও জনবসতিহীন)সহ এগারোটি আদর্শ সময় অঞ্চল (টাইম জোন)। তাই এদেশের এক রাজ্যে যখন বরফ পড়ে তখন অন্য রাজ্যে এসি ব্যবহারের দরকার পড়ে। বাড়ির বেশিরভাগ জানালা-দরজা এলুমিনিয়াম চ্যানেলের ওপর কাঁচের তৈরি। তবে বাড়ির প্রধান সদর আমাদের দেশের মতোই এক পাল্লার প্লাইউডের তৈরি। খিল-তালাচাবির ব্যবহার নেই বললেই চলে। সদর দরজা ছাড়া অন্যান্য জানালা-দরজায় বাতাস চলাচলের জন্য কিছুটা অংশে লোহার জাল লাগানো থাকে।
এখানকার ‘কিচেন’ বা রান্নাঘর বেশ আকর্ষণীয়। একেবারে আধুনিক ব্যবস্থা। চারটি বার্নারবিশিষ্ট গ্যাসওভেন বা ইলেক্ট্রিক ওভেন সব গৃহিণীদের কাছেই বেশ আদরের। এখানে গ্যাসব্যবস্থা পাইপলাইনে বহমান। তাই গ্যাসের ডেলিভারি ম্যানের প্রয়োজন পড়ে না। ইলেক্ট্রিক ওভেন যথারীতি বিদ্যুৎচালিত। প্রতিটি রান্নাঘরে ‘ফায়ার এলার্ম’ লাগানো থাকে। যদি কখনও আগুন কিংবা বেশি ধোঁয়া বের হয়, নির্দিষ্ট মাত্রা পার হলেই ‘ফায়ার এলার্ম’ বাজতে শুরু করে। অনেকক্ষেত্রে সেই আওয়াজের বার্তা পৌঁছে যায় দমকল, পুলিশ আর এম্বুলেন্স দপ্তরে। এখানকার যেকোন বিপদে দমকল, পুলিশ আর এম্বুলেন্স সমন্বয় রেখে কাজ করে। কিচেনে জলের ব্যবস্থাও বেশ আধুনিক। একই কলের মাধ্যমে দু’ধরনের জলের ব্যবস্থা। নিয়ন্ত্রণ অনুসারে কখনও গরম, কখনও ঠান্ডা জল বেরিয়ে আসে। এই ঠান্ডা জল আবার পানীয় জল হিসেবে কাজ করে।
এখানকার বাথরুম তথা ওয়াশরুমগুলো সাধারণভাবে আমাদের দেশের থেকে ভিন্ন। এখানে স্নান করার জন্য আছে বাথটব। সেখানেই গরম-ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা। আছে শাওয়ার এবং সাধারণ টিপকলের ব্যবস্থা। অস্থায়ী পর্দা বাথটবের সঙ্গে ওয়াশরুমের অন্যান্য অংশকে পৃথক করে রাখে। এখানকার প্রাতঃকৃত্যের পর ‘প্রক্ষালন’ পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো নয়। সেখানে টিস্যু পেপারের অবাধ বিচরণ।
আমাদের দেশের মতো এখানে সূর্যদেব বিশেষ কৃপা করেন না। রোদের তাপ সারাবছর সমানভাবে মেলে না। তাই কাপড়-জামা কাচার জন্য বিশেষ মেশিনের ব্যবস্থা আছে। সাধারণত বাড়ির বেসমেন্টে এই মেশিনের স্থান হয়। আমাদের দেশেও এখন ‘ওয়াশিং মেশিন’ বেশ জনপ্রিয়। এই মেশিনের দুটি ভাগ। এক- প্রায় আধঘণ্টা সময় নিয়ে মেশিনে কাচা সম্পন্ন হলে বিশেষভাবে সংকেত দেয়। দুই- তারপর সমস্ত কাপড়-জামা শুকনো করার জন্য অন্য একটি মেশিনে দেওয়া হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা সময় নিয়ে সব কাপড়-জামা শুকিয়ে থাকে। এদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের কাজ নিজে করে নিতে হয়। বাসন ধোয়া দৈনন্দিন জীবনের একটা বিশেষ অঙ্গ। এ কাজেও মেশিন সহায়তা করে। দিনের শেষে সমস্ত ব্যবহৃত বাসন একটি যন্ত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে বাসন ধোয়ার ‘লিকুইড’। দু’ঘণ্টার মধ্যে বাসন পরিষ্কার হলেই যন্ত্র আওয়াজ করে সংকেত দেয়। ঘরের মেঝে পরিষ্কার করার জন্য ঝাঁটা-ভেজা কাপড়ের ব্যবহার নেই। সে কাজও করে যন্ত্র। ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে ঘরের নানান স্থানে ‘রুম হিটার’। আবহাওয়া অনুযায়ী রুম হিটারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এদেশে বিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপক। আমাদের দেশে যেমন ২২০ ভোল্টে বিদ্যুৎ চলে, এখানে সেটা চলে ১১০-এ। এসব বাড়ির এত কিছুর নিয়ন্ত্রণে যদি কোন অসুবিধা হয়, তার জন্য আছে হেলফলাইন। সেই বিশেষ নম্বরে ফোন করলেই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং সমস্যার সমাধান মেলে।
পরিচ্ছন্নতা এদেশের সম্পদ। নিয়মানুবর্তিতা এদের অলংকার। প্রধানত এই দুই বিশেষণকে হাতিয়ার করে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ একসাথে বাস করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে।
পূর্বকোণ/মাহমুদ