স্বাভাবিক নিয়মে দুই থেকে আড়াই বছর বয়সে একজন শিশু একটু আধটু কথা বলা শুরু করে। ছোট ছোট বাক্যে কথা বলতে পারে। কিন্তু জন্মের পর পরই মায়ের কোল অথবা দোলনায় থাকা অবস্থায় কথা বলা অস্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এমন চার শিশু আছে যারা অস্বাভাবিক কাজটি করেছে। যারা আল্লাহ পাকের হুকুমে নবজাতক অবস্থায় কথা বলেছিল! কারণ আল্লাহপাক যা চান,তা হয়ে যাওয়া মুহুর্তের ব্যাপার। সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রাণাধীন। কোন কিছু হয়ে যাও, বলার সাথে সাথে অমনি তা হয়ে যায়।
জন্মের পরই মায়ের কোলে কথা বলা প্রথম শিশু ফেরাউনের বাদীর সত্যের ওপর অটল থাকার সাক্ষী দেন। ফেরাউনের মেয়ের চুল আঁচড়ে দেয়ার সময় হাত থেকে চিরুনি পড়ে যায়। বাদী সেটি তোলার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলেন। ফেরাউনের মেয়ে তা শুনে ফেলে। ফেরাউনের মেয়ে বাঁদীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই পৃথিবীতে একমাত্র খোদা হলেন আমার আব্বা! তুমি কার নাম নিলে।’
বাদী তখন নতুন ধর্মের সংবাদ দেন এবং বলেন, আমি এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি, মুসা (আ:)-কে সত্য নবী হিসেবে মানি। ফেরাউনের মেয়ে সাথে সাথে এই খবর ফেরাউনকে বলে দেয়। ফেরাউন বাঁদীকে সভায় উপস্থিত করাল। প্রথমে হুমকি ধমকি দিতে থাকে। তার ধর্ম থেকে ফিরে আসতে বলে, ফেরাউনকে খোদা হিসেবে মানার জন্য বলে। ফেরাউনের বাঁদী তা অস্বীকার করেন। মুসা (আ.) কে নবী ও আল্লাহকে রব মানার কারণে ফেরআউন চরম ক্ষুদ্ধ হন। যদি মুসার ধর্ম ত্যাগ না করে, বাঁদীর কোলে থাকা সদ্যজাত সন্তানকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করার আদেশ দিলো ফেরাউন।
বড় কড়াইয়ে তেল উত্তপ্ত করে তাতে ফেলার জন্য দুই কন্যাসহ মহিলাকে ডেকে আনেন। প্রথম সন্তানকে কড়াইয়ে ফেলে হত্যার পর মা ইতস্তত করছিলেন। এমন সময় কোলের দ্বিতীয় সন্তানের জবান খুলে দিলেন আল্লাহপাক। তখন কোলের শিশুটি বলে উঠলো “মা তুমি হকের উপর আছ,সত্যের ওপর অটল থাক, একটু পরে জান্নাতে দেখা হবে”। সন্তানের মুখে এ কথা শোনে, বাঁদীটির ঈমান আরো মজবুত হলো। তাকেও হত্যা করা হলো। পরে মায়ের অনুরোধ ছিল, তাদের সবার হাড় যেন একইস্থানে রাখা হয়। ফেরাউন মাকেও একইভাবে হত্যার পর তাদের একত্রে দাফন করে।
রাসূলে করীম (সা.) শবে মেরাজ থেকে ফেরার সময় মিশর হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে যাচ্ছিলেন নামাজ আদায়ের জন্য। এ সময় নবীজি জান্নাতের খুশবু পান। নবীজি জিবরাঈলকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের খুশবু । উত্তরে জিবরাঈল বলেন, “কবর থেকে খুশবু আসছে। মুসা (আ.) কে নবী ও আল্লাহকে রব মানার কারণে ফেরাউন তার বাঁদীকে দুই সন্তানসহ হত্যা করেন। এই শহীদদের কবর থেকে বের হচ্ছিল জান্নাতের খুশবু”।
নবজাতক শিশুদের মধ্যে দোলনায় থাকা অবস্থায় কথা বলা দ্বিতীয় শিশু হলেন- ঈসা (আ.)।তিনি মরিয়ম (আ:)এর পবিত্রতা ঘোষণা করেন। ইমরান (আ:) এর বিবি নিয়ত করেন, গর্ভে থাকা সন্তানকে বায়তুল মুকাদ্দাসে খেদমতের জন্য পেশ করবেন।
কিন্তু তাঁর গর্ভ থেকে আসলেন একজন মেয়ে শিশু। এতে ইমরান (আ:) এর স্ত্রী বিপাকে পড়ে যান। কারণ মেয়েতো মসজিদের খেদমত করতে পারবে না। আল্লাহর হুকুমে মরিয়ম (আ:)কে বায়তুল মুকাদ্দাসে খেদমতে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই মরিয়ম (আ:) আল্লাহর ইবাদত করেন এবং আল্লাহর কুদরতি ফলাদি থেকে আহার করতেন! আল্লাহর তরফ থেকে বে-মৌসুমের ফলও পেতেন তিনি। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, মরিয়ম (আ:) থেকে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটানো।
মরিয়ম আ:-এর কোলে আসে একটি ফুটফুটে শিশু সন্তান! এলাকায় শোরগোল পড়ে গেল, ‘মরিয়মকে আমরা দ্বীনদার বলে জানতাম। আল্লাহর খাস বান্দী বলে জানতাম, অথচ কোনো বিয়ে-শাদী ছাড়া সন্তান ভূমিষ্ট হলো!’ অপবাদ দিতে লাগল একে একে সবাই।
সেই অপবাদের কঠোর প্রতিবাদ করে নবজাতক শিশুটি। ‘মরিয়ম (আ:)এর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং নিজের নবী হওয়ার আগাম পয়গাম দেয়! শিশুর কথা বলা দেখে সবাই অবাক হয় এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পারে! সেই শিশুটি হলেন ঈসা (আ:)!
আর বনী ইসরাঈলের জুরায়জ নামে এক ব্যাক্তি নামাজ পড়ছিল।এমন সময় তার মা তাকে ডাকলে সে চিন্তা করল, আমি জবাব দেব না, নামাজ পড়তে থাকব। সাড়া না পেয়ে তার মা দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ যেনাকারীনির চেহারা না দেখা পর্যন্ত যেন তার মরণ না হয়’।
জুরায়জ তার এবাদতখানায় থাকতো। একদা এক মহিলা এসে তার সাথে কিছু কথা বলে তাঁকে দৈহিক স্পর্শদানের আহবান করলে সে প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর মহিলাটি এক রাখালকে দিয়ে তার মনোবাঞ্জা পূরণ করে। পরে মহিলা একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে অপবাদ দিয়ে বলল, এটি জুরায়জের সন্তান।এতে লোকজন জুরায়জের এবাদাতখানা ভেঙ্গে দেয়। এবং তাকে নিচে নামিয়ে এনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। তখন জুরায়েজ গিয়ে অযু করে নামাজ পড়ে শিশুটিকে জিজ্ঞস করল, হে শিশু, তোমার পিতা কে? সে জবাব দিল অমুক রাখাল। তখন লোকেরা তাদের ভুল বুঝতে পারল। তখন তারা ভাঙ্গা এবাদতখানা স্বর্ণ দিয়ে বানিয়ে দিতে চাইল। সে বলল, না মাটি দিয়েই বানাও।
বনী ইসরাঈলের এক মহিলা তার শিশুকে দুধ পান করাচ্ছেন। এসময় তার পাশ দিয়ে আরোহী এক সুপুরুষ চলে গেল। মহিলা দোয়া করল, ‘হে আল্লাহ, আমার ছেলেটিকে তার মতো বানিয়ে দাও’। শিশুটি তখন মায়ের দুধ ছেড়ে দিয়ে আরোহীর দিকে ফিরে বলল, ‘হে আল্লাহ,আমাকে এর মত বানিও না’। তারপর দুধ চুষতে লাগল। আবু হরায়রা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল নিজের আঙ্গুল চুষে শিশুটির দুধ পানের অবস্থার ইঙ্গিত দেন’। আমি যেন এখনো তা দেখতে পাচ্ছি।
পুনরায় সেই মহিলার পাশ দিয়ে এক দাসীকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মহিলা দোয়া করল, ‘হে আল্লাহ,আমার ছলেটিকে তার মতো করো না’।ছেলেটি সাথে সাথে মায়ের দুধ ছেড়ে দিয়ে বলল,‘হে আমার প্রভু, আমাকে তার মতো করো’। মা জিজ্ঞেস করল,কেন? শিশুটি উত্তর দিল, আরোহীটি ছিল জালেমদের অন্যতম। আর দাসীটিকে লোকেরা বলছে তুমি চুরি করেছ, যেনা করেছ, অথচ সে কিছুই করেনি।
এসব দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে কেউ বিপদগামী করতে পারবে না। হকের উপর থাকলে সত্যের জয়, মিথ্যার পরাজয়, ষড়যন্ত্রকারীরা লজ্জিত হবে অবশ্যই। সর্বদা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা। সবশেষে বলা যায়-আমরা যাকে ভাল মনে করি, প্রকৃতপক্ষে তিনি ভাল নাও হতে পারেন। পক্ষান্তরে আমার যাকে খারাপ মনে করি, প্রকৃতপক্ষে তিনি খারাপ নাও হতে পারেন। তাই না জেনে ধারণাবশত কোন বিষয় সম্পর্কে বলা নিষিদ্ধ বা হারাম।
লেখক: ব্যুরো চিফ, বাংলাভিশন চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/এএইচ