কখনো ভাবিনি এভাবে আমাদের ভাই রাফির মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত লিখতে হবে। গতরাত থেকেই অনেকের অনেক পোস্ট, মেনশন, কল সবই পাচ্ছি। তাই বিস্তারিত না লিখেও পারছিনা। বর্ষা, আবির ও আরো কয়েকজন ট্যুরমেটের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী এই লেখাটা দিচ্ছি সবার পক্ষ হয়ে।
ঘটনার সূত্রপাত শনিবার বিকেল ৩ টায়। রাফি মোট ২৪ জনকে সাথে নিয়ে পাড়ার এক লোকাল গাইডকে নিয়ে সাইংপ্রা ঝর্ণা দেখতে যায়। ঝর্ণা দেখে ফেরার সময় সেকেন্ড স্টেপ হতে পা পিছলিয়ে রাফি হঠাৎ পড়ে যায়। সে মূলত খালি ঝর্ণাতে ছবি ও ভিডিও করার জন্য একটু আগে যেতে গিয়ে পা পিছলিয়ে পড়ে যায়। যখন সে পড়ে যায় তখন ওর সাথে বর্ষাসহ আরও ৬ জন ছিলো। আরেকটু সামনেই ছিলো আবির। পড়ে যাওয়ার পর আবিররাসহ মোট ১০ জনে রাফিকে উঠিয়ে ব্লিডিং বন্ধ করার চেষ্টা করে। টিমের বাকিরা কিন্তু এই ঘটনা তখন জানে না। বাকি সদস্যরা তখন পাড়ার দিকে ফিরছিলো। এই অবস্থায় আবির, লোকাল গাইড, বর্ষাসহ মোট ৯ জন মিলে রাফিকে ঝিরি দিয়ে আনার চেষ্টা করে।
৫.৩০টার দিকে তারা প্রায় ঝিরিপথ শেষের দিকে চলে আসে। এরপর রাফির অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়। তখন সেন্সলেস অবস্থায় থাকে রাফি। এই অবস্থায় একটু উপরে উঠে কয়েকজন নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা চালায়। এরমধ্যে নেটওয়ার্ক না পেয়ে আবির আর বর্ষা ৬জনকে নিয়ে রাফিকে ঝিরির শেষ দিকে রেখে পাড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু ওরে নিয়ে যেতে হলে পাহাড়িদের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব না। ওরা পাড়ায় পৌছাতেই প্রায় ৮.৩০ টা বাজে। এরমধ্যে আবির জুমে লোকজন দেখে ২ জন দাদাকে বলে নিচে পাঠায়। পাড়ায় গিয়ে আবির ও বর্ষা ডন দাদাকে বিস্তারিত জানায়। আর পাড়া থেকে কাউকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায়। তখন কেউ এই রাতের বেলা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে যেতে রাজি হচ্ছিল না। অনেক কিছুর পরে ৮ জন পাড়ার লোক যেতে রাজি হয় ৯টায়। দাদারা যাওয়ার সময় আশ্বস্ত করেছিলো যে তারা রাফিকে নিয়েই আসবে পাড়ায়। এরপর বর্ষা ও আবির গেলো নেটওয়ার্কের খোঁজে। ক্রিসতং যাওয়ার সময়ের ট্রেইলে যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেখানে। ঠিক ৯.৫২ মিনিটে মুরাদের কাছে কল আসে। বর্ষা বলছিল, মুরাদ ভাই রাফি তো এক্সিডেন্ট করেছে। ও তো আমার কাছে আর নাই বলেই কান্না…। পরে জিজ্ঞেস করলাম পাশে কে? আবিরের সাথে বিস্তারিত কথা বলেই ফোন দিলাম মিন্টু ভাই, জমির ভাই, আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আরো কয়েক জায়গায়।
এরপরেও আলীকদম গাইড সমিতির লোকেরা চেয়ারম্যানসহ নানারকম চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে কাউকে পাঠানোর মতো রিক্স তারা নিতে সক্ষম হয়নি। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে খবর যায়। ওরাও এরমধ্যে বিস্তারিত জেনে কি করা যায় তার চেষ্টা চালাতে থাকে। এদিকে রাফির পরিবারের পক্ষ থেকেও চেষ্টা চলাচ্ছে, কীভাবে কি করা যায়। এরপর ঠিক রাত ১১.০৫ এ আমার কাছে আবারো কল আসে আবিরের। কি ব্যবস্থা বা কি করতে পারলাম তা জানার জন্য। সত্য বলতে আমরাও তখন অসহায়। কিচ্ছু করতে পারছিলাম না। ওরা তখন বলে যায় হয়তো রাফিকে নিয়ে আসবে দ্রুত। ওরা পাড়ায় যাক আর আমাকে ৪০ মিনিট পরে আপডেট দিবে আবার। এদিকে এরমধ্যে আলীকদম সেনাবাহিনীর জোন কমাণ্ডারের সাথেও আলাপ হয়। উনিও লোকেশন জানলো এবং ওদের সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা অব্যাহত রাখলো, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে উঠছেনা। কারণ ওরা তখন পাড়ায়, নেটওয়ার্ক তো নেই। এরপর আবিররা পাড়ায় যায় ১১.৪০ এ। গিয়েই বাকি ১৩-১৫ জন মেম্বার যারা ছিল ওদেরকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে।
তখনো কিন্তু সবাই জানে রাফি জীবিত আছে। এরমধ্যে ১২টার পরেই লোকাল গাইডসহ ঐ ৬ জন পাড়ায় ফিরে আসে। ২ জনের অবস্থা তখন আশংকাজনক। ওদের দেখেই আবিররা জিজ্ঞেস করে রাফি কই? ওরা বলে রাফিকে ওরা রেখে আসছে। দাদারা আনছে, নিয়ে আসবে। একটা কথা জানিয়ে রাখি- দাদাসহ ঐ ৬ জন তখন জেনে গেছে রাফি আর নেই, সে মারা গেছে। তাদের কাছে কোন লাইট ছিলো না। এই ঠাণ্ডার মধ্যে সাইংপ্রা ঝিরিতে একটা লাশ নিয়ে অন্ধকারে বেশিক্ষণ টিকে থাকা আসলেই সম্ভব না। দাদা যখনই বলছে রাফি মারা গেছে। উনি থাকবে না। তখনই ওই ৫ জনও থাকার মতো সাহস আর পাইনি। পাহাড়ে নতুন গিয়েই যদি এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় তাহলে আপনি আমি কেউ পারবনা।
সিচুয়েশনটা কি হয়েছিলো, ওদের মধ্যে দিয়ে কি গেছে স্রেপ ওরা বুঝছে। ওরা যখন পাড়ায় ফিরলো, তখন রাত ১২ টারও বেশি। এরপর তাদেরকেও খাওয়ানো হলো ভাত। খেয়েদেয়ে এবার বর্ষা আর আবির পুনরায় ঝিরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন একটু আগে যারা এসেছিলো ওদেরকেও অনেক রিকুয়েষ্ট করা হয়। বস্তুত তখন সব ট্যুরমেটদের অবস্থায় খারাপ। সেই সকাল ৯টায় খাওয়া,সারাদিন বৃষ্টিতে ভেজা। এই কঠিন সাইংপ্রা ট্রেইল করে এসে পাড়ায় আসা। এসেই এসব খবর শোনা। আবার সেই ঝুম বৃষ্টিতে ওরা আবার যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া কতোটা সম্ভব তা আমার জানা নেই।
আরেকটা কথা বলে রাখি- লোকাল গাইড যখন শুনেছে রাফি মারা গেছে তখনই বাকি ৮ জন গাইডকেও জানিয়ে দিয়েছে মারা যাওয়ার খবর। মুরংদের একটা রীতি আছে তা হলো ওরা রাতের বেলা লাশ ধরে না। আপনি লাখ টাকা দিলেও ধরবেনা। আর পাড়াতেও লাশ আনবে না ওরা। ওরা ওই অবস্থায় রাফিকে হ্যামকে বেঁধে পঞ্চ দিয়ে ঘুরে রেখে বাঁশের কাছে ঝুলিয়ে রেখে দেয়, যাতে পানিতে ভেসে না যায় না। বা বন্যপ্রাণী আক্রমণ না করে। ৮ জন দাদা রাত ২টায় পাড়ায় পৌঁছাই, আর সবাইকে জানাই যে রাফিকে ওরা জুমঘরে রেখে এসেছে। জোঁক আর অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য পাড়ায় আনতে পারছেনা। সকালে আনবে। এই রাত ২টায় আবির আর বর্ষা বাকি মেম্বারদের রিকুয়েষ্ট করে, ওরা গিয়ে নিয়ে আসবে এরকম। কিন্তু কেউ তখন আর রেস্পন্স করার মতো অবস্থা নাই। এরকম বৃষ্টির মধ্যে যদিও আবার পাড়া থেকে ওই ঝিরিতে যেতে হয় তবে ২-৩ ঘণ্টা লেগে যেতো। বলে রাখি এরমধ্যে আবির, বর্ষাসহ আরো ৪ জন অসুস্থ হয়ে গেল।
এদিকে সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে মেনিকিউ পাড়া থেকে রাতের ১২টায় ৪ জনের টিম পাঠাই খেমচং পাড়ার উদ্দেশ্যে। এরা খেমচং পাড়ায় পৌঁছে ভোর ৫.৩০। ওরা পৌঁছেই ওই ৮ জন দাদাসহ মোট ১৬জন রাফিকে আনতে যাওয়ার জন্য বের হয়। বলাবাহুল্য ভোর ৫টার দিকে ঐ ৬ জনের কারো মুখ থেকে হঠাৎ করেই বের হয়ে যায় রাফি মারা গেছে। এবার এটা শুনে সবার অবস্থা শেষ। আগের দিনের ট্যুরমেট ২ জন নিয়ে দাদারাসহ ১৭ জন মিলে রাফিকে ভোরে উদ্ধার করে।
এদিকে নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকায় আমরা কেউ সঠিক খবর পাচ্ছিলাম না। এরপর সকালেও কোন তথ্য পাচ্ছিলাম না। ১১ টার দিকে নিশ্চিত হই যে রাফি আর নেই। বলে রাখি ফাহাদ হিমু ভোরেই আলীকদম পৌঁছাই। সে সকাল থেকেই রাফির লোকাল অভিভাবক হয়ে বাকি ফরম্যালিটিগুলো করতে থাকে। এরমধ্যে ১১টায় আবির ফোন দেয় মেনিয়াং পাড়ায় এসে। ওরা নিয়ে আসছে। দাদাদের টাকা দিতে হবে তাই দুসরী বাজার টাকা নিয়ে যেতে বলে। আমি (মুরাদ) তখন চট্টগ্রাম থেকে মাত্রই রওনা দিয়েছি। হিমুকে দিয়ে রাফির বন্ধু রাসেল ভাই ২০ হাজার টাকা পাঠায়। আর তখনই হিমু,জমির ভাই মিলে দুসরী বাজারে যায়। আমতলী ঘাটে লাশ আসে সন্ধ্যা ৭.০৫ মিনিটে।
আর এরপরের বাকি ঘটনা তো সবার জানা। এই জিনিসটা ক্লিয়ার করা খুব জরুরি ছিলো তাই করলাম। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের ভাই মারা গেছে। তার জন্য দোয়া করুন। তাকে নিয়ে আর কেউ কোনো উল্টো পালটা লিখিয়েন না। নোংরামি করেন না। তার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
পরিশেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, আলীকদম চেয়ারম্যান, গাইড সমিতি, মুরং সমিতি, পাড়ার লোক ও লোকাল সকল মানুষকেই ধন্যবাদ।
আপনাদের এই সহযোগিতা না পেলে হয়তো ভাইয়ের লাশ এতো সহজেও পেতাম না।
পরিশেষে কিছু কথা
👉 ঘটনা পড়লে বুঝতে পারবেন যে রাফির স্ত্রী বর্ষা, আবির বা বাকি মেম্বারদের কোনোভাবেই দোষ দেয়া যায় না। ঐ অবস্থায় কারোরই হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
সবাই সবার জায়গা থেকে যতটুকু পারছে করেছে।
👉 এখানে বিস্তারিত যা লেখা হয়েছে আবির, বর্ষা এবং কিছু মেম্বারদের থেকে তথ্য নিয়ে লেখা। ওরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলো যার কারণে অনেকে অনেকভাবে শুনেছেন।
এই বিস্তারিতটা অথেনটিক এবং সত্যঘটনা। আরও একটা বিষয় হল রাফির মৃত্যু নিয়ে কেউ নিজের প্রোফাইল ভারি করতে যাইয়েন না আল্লাহর ওয়াস্তে। মৃত মানুষটার এটা-ওটা ভুল বলতে যাইয়েন না।
সবাই সবার জায়গা থেকে যথেষ্ট করেছে কিন্তু এটা নিয়ে ক্রেডিট বলেন আর মার্কেটিং বলেন এসব করতে যাইয়েন না।
সকলেই দোয়া করবেন রাফি যেন জান্নাতবাসী হয়।
পূর্বকোণ/এসি