চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী: বিশ্বশান্তির প্রতীক বঙ্গবন্ধু

জুয়েল দাশ

২৩ মে, ২০২৩ | ১১:১০ অপরাহ্ণ

বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার বাতিঘর, বাঙালির হাজার বছরের দুঃখ মোচনের লড়াইয়ে অবিচল নিষ্ঠার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ ২৩ মে, বাঙালি জাতির জনক, বিশ্বমানবতার এই মহানায়কের আন্তর্জাতিক ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় একাগ্রতা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্বশান্তিতে অবদান রাখায় ১৯৭৩ সালের এ দিনে বিশ্ব শান্তি পরিষদ (ডব্লিউপিসি) বঙ্গবন্ধুকে সম্মানজনক এই শান্তি পদকে ভূষিত করে।

 

জুলিও কুরি শান্তি পদক বিশ্বের শান্তি পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা এবং মানবতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারা এই পদকে ভূষিত হন। বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে এই পদক দিয়ে আসছে। শুরুতে এটি শান্তি পদক বা মেডেল অব পিস নামে দেওয়া হলেও ১৯৫৯ সাল থেকে নোবেলবিজয়ী ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরির স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি জুলিও কুরি শান্তি পদক হিসেবে চিহ্নিত হয়। মূলত ফ্রেডেরিক ছিলেন একজন মানবতাবাদী বিজ্ঞানী, যিনি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যুদ্ধের পরিবর্তে মানবকল্যাণে ব্যবহারে উদ্যোগী ছিলেন। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সম্মানার্থে ১৯৫৯ সাল থেকে এটি জুলিও কুরি শান্তি পদক নাম হয়।

 

বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাজীবন কাটিয়েছেন দরিদ্র, দুঃখী, নিপীড়িত ও মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। নব্য-উপনিবেশিক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির কপালে যে বঞ্চনার তীলক এঁকে দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে হুঁশিয়ার করেছেন। তাঁর প্রজ্ঞা, মানবতাবাদী রাজনৈতিক দর্শন, প্রখর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব এদেশের মুক্তিকামী ও শান্তিকামী মানুষদের দিয়েছিল দিশা। তিনি তাদের নিয়ে এসেছিলেন হানাদার শক্তির বিরুদ্ধে এক কাতারে। আর আমরা পেয়েছি স্বাধীন এই মাতৃভূমি।

 

শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও যেখানেই তিনি মানবাধিকারের লঙ্ঘন দেখেছেন, মানুষের ন্যায্যতা খর্ব হতে দেখেছেন সেখানেই বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বিশ্বসভায় সারাবিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিকসহ বিভিন্ন দেশের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে সে সময়ের উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন, পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শাসক ও শোষিত। কিন্তু, আমি শোষিতের পক্ষে।

 

বঙ্গবন্ধুর শান্তিনীতির অন্যতম দিক এই যে, কেবল যুদ্ধের অনুপস্থিতি শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এর সাথে সাথে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তাই কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাইতো স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠন, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য তিনি ছিলেন অটল। ছুটেছেন মানুষের কাছে। কাজ করেছেন তাদের সাথে। আর তাঁর কাজের মূল উদ্দেশ্যই ছিল একটি শোষণমুক্ত সমাজ তথা দেশ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, আমার সারা জীবনের স্বপ্ন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এভাবেই বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই হয়েছিলেন বাংলার আপামর মানুষের প্রাণের বন্ধু।

 

বঙ্গবন্ধু সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক শ্রদ্ধায়। তাইতো স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্ব যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদ ও রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদ এই দুটি ভাগে ভাগ ছিল, তখন তিনি কোনো জোটে যাননি। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি যোগ দিয়েছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে (ন্যাম)। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি দেখিয়েছিলেন প্রজ্ঞা। যার ভিত্তি ছিল সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করার কথা বলেছেন। বলেছেন- আর এতেই পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজ হবে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আপনজন। বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বশান্তি পরিষদের তখনকার মহাসচিব রমেশচন্দ্র। রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’

 

১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০ দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিশ্বশান্তি পরিষদ আয়োজিত এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্সে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু যখন এই শান্তি পদক পান তখন হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের সরকার প্রধানকে শান্তি পদক প্রদান ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার নিরলস প্রচেষ্টা, কর্ম ও প্রজ্ঞার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষদের। তিনি বলেছিলেন, এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতার বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।

 

বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ আজ যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িক উগ্রতা, সহিংসতা, অর্থনৈতিক বাধা, দারিদ্রতাসহ নানান অনাচারের জাতাকলে নিষ্পেষিত। মানুষ শান্তির জন্য, মুক্তির জন্য একটু পথ খুঁজছে। আর এমন একসময় বঙ্গবন্ধুর মানবতাবাদী কাজ ও দর্শন এবং এর ভিত্তিতে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট