চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

তপ্তরোদে কাজ করা দিনমজুরের কথা বলার ভাষা আছে?

২৯ মার্চ, ২০২৩ | ৫:০৯ অপরাহ্ণ

আমাদের পরিবারগুলো যদি জানতো যে একজন পুরুষ সকালে ঘর থেকে বের হয়ে রাতে ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত কি পরিমাণ পেরেশানি আর পরিশ্রমের সাথে যুদ্ধ করে ফিরে আসে।

স্ত্রী সন্তান মা বাবা ভাইবোনের সুখ শান্তির জন্য নিজেকে ভেঙেচুরে বিকিয়ে দিয়ে- দিন শেষে একটু বিশ্রামের জন্য বাসায় ফিরে। বেশিরভাগ পুরুষই দিন শেষে বাসায় ফিরেও শান্তি পায় না। সকালে বের হয় রুজিরোজগারের যুদ্ধে আর রাতে ঘরে ফিরলে শুরু হয় পারিবারিক ঘ্যানঘ্যানানি। যারা দায়িত্ব পালনে নিজেকে উজাড় করে দেয় – আমরা তাদের উপরই দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে দিতে তাদেরকে যন্ত্রমানবে পরিণত করে ফেলি।

অথচ কেউ ভেবেও দেখে না- এই লোকটা তাদের সুখের জন্য সারাদিন কেমন যুদ্ধ করে বাসায় ফিরেছে। যে লোকটা রিকশা চালায়- সে সারাদিন ৫ টাকা বেশি ভাড়ার জন্য ৫০০ বার প্যাডেল মারতে হয়- যে লোকটা বাসের হেল্পার – তাকে যাত্রীর অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুনতে হয়। যে লোকটা দালালি করে – একশো টাকার জন্য তাকে কতো অপমান অপদস্ত হতে হয়। যে লোকটা বেচা বিক্রি করে – তাকে খরিদ্দারের সাথে কতো ধরনের তর্কবিতর্ক করতে হয়!!

যে লোকটা পুলিশ আর্মি বিজিবি কিংবা আনসার- তাকে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। যে লোকটা সাংবাদিক- তাকে সব সময় কারও না কারও নিশানায় থাকতে হয়। যে লোকটা গার্মেন্টস কিংবা এমন উৎপাদন খাতে চাকরি করে – তার ঘামের হিসাব করার সাধ্য নাই। আর যে লোকটা আগুনের চুলার পাশে সারাটাদিন বাধ্য হয়ে কাজ করে- তার যন্ত্রণা অবর্ণনীয়। তপ্তরোদে কাজ করা দিনমজুরের কথা বলার ভাষা আছে?

যে লোকটা উকিল – তাকে ৫০০/১০০০ টাকা ফি’র জন্য গরমের মধ্যেও কালো কোট পরে কতো সত্য-মিথ্যা যুক্তি দিতে হয়! মাস্টার্স পাশ করা ওষুধ কোম্পানির স্মার্ট প্রতিনিধিই জানে যে; প্রেসক্রিপশন ক্রিয়েট করা কিংবা সেলস টার্গেট পূরনের জন্য ডাক্তার কেমিস্টের সামনে প্যান্ট খুলে ‘তওফা কবুল কর’ বলার অবস্থা হয়।

আমার মতো যে অধমেরা ভিআইপি ভিভিআইপিদের নিকটতম সহকারী হিসেবে কাজ করে – তাদের সুপার ক্রাইসিস ম্যানেজার বলতে হবে। একদিকে পাব্লিকের আকাশচুম্বী চাহিদা অন্যদিকে বসের মেজাজ মর্জি, সময় অসময়, সুস্থতা অসুস্থতা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, পরিবার পরিজন, রাজনীতি সমাজনীতি, তেলবাজ ফাঁফরবাজ, হাইব্রিড তৃণমূল, বিরোধী কিংবা বিদ্রোহী – কত্তো কিছুর ধকল সামলাতে হয়! সারাদিন থানা পুলিশ, চেয়ারম্যান মেম্বার, চোর জোচ্চর, ঠিকাদার ব্যবসায়ী, আহত নিহত, মিছিল শ্লোগান, সাংবাদিক, টেলিফোন, তদবির সুপারিশ ফাইলপত্র – সবকিছুর ভিড় ঠেলে বাসায় ফিরেও সদাপ্রস্তুত থাকতে হয় – ফোন এলেই দৌড় দিতে হবে। আমাদের মতো চাকরিজীবিদের রাত নেই – দিনও নেই। বসের দুই মিনিটের কাজের জন্য আমাদের দুই ঘন্টা কিংবা দুইদিনও লেগে থাকতে হয়।

যে লোকটা বড় ব্যবসায়ী- তাকে সারাদিন তারচেয়েও বড় বড় ব্যবসায়ী সামলাতে হয়; যে লোক একজন সচিব – তাকে মন্ত্রী সামলাতে হয় ; যে লোকটা এমপি কিংবা মন্ত্রী – তাকে প্রধানমন্ত্রী সামলাতে হয়। আবার প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হলেও – তাদেরকে জনগণ এবং বহির্বিশ্ব সামলাতে হয়।

আর যে কর্মজীবী মা অথবা নারী!! ওহ আল্লাহ!! তার ত্যাগ সহনশীলতা শ্রম যুদ্ধ পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ!! বর্ননা করার ভাষা আমার জানা নেই। ঘর সংসার কর্মস্থল রাস্তাঘাট হাট-বাজার- সবখানেই তার যুদ্ধ!

এই মানুষগুলো সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে ঘরে ফিরলে– ঘরের মানুষগুলো যদি তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপটাকে সম্মান করে দু একটা কথা বলে – লোকটা সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যায়। সারাদিন যুদ্ধ করে আসা এই মানুষটাকে কেউ দরজা খুলে দিয়ে হাঁসি মুখে “এসেছো?’

প্রশ্ন করলে, কিংবা হাতের ব্যাগটা টেনে নিলে, কিংবা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলে – লোকটা সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যায়।

অথচ বেশিরভাগ ঘরে এই মানুষ গুলোর প্রতি উদাসিন থাকে। সংসারের সবচেয়ে বড় দায়িত্বপালনকারী মানুষটার উপর থেকে ছোট ছোট ঝুট-ঝামেলা গুলো কমিয়ে দিয়ে – তাকে কিছুটা স্বস্তি আর বিশ্রামের সুযোগ করে দিলে কিংবা ছোটখাটো কিছু কাজ পরিবারের অন্যান্য মানুষ গুলো ভাগ করে নিলে – তারা সবাই ভালো থাকতো।

এই যন্ত্রমানবগুলো মৃত্যুবরণ করলে আমরা ধাক্কা খেয়ে সব দায়িত্ব পালনে বাধ্য হই। অথচ বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি তার প্রতি ইনসাফ করি না।

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট