চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সফর কিংবা বাড়ি থাকা অবস্থায় যিনি ছিলেন নবীজীর একান্ত কাছে

৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির দ্বিতীয় বছরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাদি.)এর জন্ম। নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরে তার পিতা হযরত উমার (রাদি.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন আবদুল্লাহর বয়স প্রায় পাঁচ। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আবদুল্লাহ নিজের বাড়িটি ইসলামের আলোকে আলোকিত দেখতে পান। ইসলামী পরিবেশেই তিনি বেড়ে ওঠেন।

 

হযরত উমার (রাদি.) কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবার-পরিজনসহ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। পিতার সাথে আবদুলল্লাহও মদীনায় চলে যান। হিজরতের পর সত্য-মিথ্যার প্রথম সংঘর্ষ হয় বদর প্রান্তরে। ইবনে উমার তখন তের বছরের কিশোর। জিহাদে যোগদানের আবেদন জানালেন। জিহাদের বয়স না হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। এক বছর পর আবার সামনে এলো উহুদের যুদ্ধ। এবারও তিনি নাম লেখালেন। একই কারনে এবারও রাসূলুল্লাহ (সা.)-র অনুমতি লাভে ব্যর্থ হলেন। এর দুই বছর পর হিজরী পঞ্চম সনে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবদুল্লাহর বয়স তখন পনের। এই প্রথম তিনি জিহাদে গমনের জন্য রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুমতি লাভ করেন।

 

এর পর থেকে ক্রমেই তিনি নবীজীর দরবারে আদরে শাসনে বড় হতে থাকেন। জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং নিভৃতচারী। পিতার ওফাতের পর সর্বপ্রথম ইবনে উমারকে খলীফা নির্বাচনের মজলিসে দেখা যায়। হযরত উমার অসীয়াত করে যান যে, পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে আবদুল্লাহ শুধুমাত্র পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করবে। তাকে খলীফা বানানো চলবেনা। প্রশাসনকে আত্মীয়তার বেড়াজাল ও অপবাদ থেকে মুক্ত রাখার তার একি সূচিন্তিত প্রয়াস! আজকে আমাদের সমাজ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যে নিকৃষ্ট উদাহরনে পরিণত হয়েছে হযরত উমারের মত মহানুভব শাসককে অনুসরণ করলে আদর্শহীন মেধাহীন পরিবারতন্ত্রের নিগঢ়ে আবদ্ধ হয়ে সাধারন মানুষের নাভিশ্বাস হতো না।

 

সে যা হোক, খলীফা উসমান (রাদি.) স্বীয় শাসনামলে তার পূর্বেকার খলীফার সুযোগ্য সন্তান আবদুল্লাহকে কাজীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, আমি দুই ব্যক্তির মাঝে না ফয়সালা করে থাকি, না দুই ব্যক্তির ইমামতি করে থাকি। কারন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘কাজী তিন শ্রেণীর। এক, জাহিল। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। দুই, দুনিয়াদার আলিম। তারাও জাহান্নামী। তিন, যারা ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হয়। তাদের জন্য না শাস্তি না পুরস্কার।’ খলীফা বললেন, ‘তোমার পিতাও তো ফয়সালা করতেন।’ বললেন : হাঁ, এ কথা সত্য। তবে কোন সমস্যায় পড়লে রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে যেতেন। রাসূল (সা.) ও যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ হতেন তখন জিবরাঈলের শরনাপন্ন হতেন। কিন্তু আমি এখন কার কাছে যাব? আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে অব্যাহতি দিন। খলীফা তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।

 

তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, এ কথা তিনি অন্য কারো নিকট প্রকাশ করবেন না। কারণ খলীফা জানতেন, লোকেরা যদি জানতে পারে ইবনে উমার কাজীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাহলে এ পদের জন্য আর কোন সত্যনিষ্ঠ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। খিলাফতের দায়িত্ব থেকে দুরে থাকলেও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে কখনো দূরে থাকেননি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর। ইসলামি অভিযানের ডাক যখন এসেছে, সাড়া দিয়েছেন।

 

হিজরী ৭৪ সনে ৮৩ অথবা ৮৪ বছর বয়সে তিনি ইনতেকাল করেন। হজ্বের সময় এক ব্যক্তির বিষাক্ত বর্শার ফলা তাঁর পায়ে বিঁধে যায়। এই বিষেই তার শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, শুধুমাত্র ঘটনাক্রমে এমনটি হয়নি, বরং এর পেছনে তৎকালীন জালিম শাসক হাজ্জাজের ইঙ্গিত ছিল। কারণ ক্ষমতা টিকিয়ে থাকার জন্য পবিত্র কা’বায় মহান মুজাহিদ আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের ওপর আক্রমন চালানোর ব্যাপারে ইবনে উমার হাজ্জাজকে ভীষণ তিরস্কার করেছিলেন। এতে হাজ্জাজ ক্ষুব্ধ হন এবং সুযোগ বুঝে প্রতিশোাধ নেন। সফর ও ইকামাত বা বাড়ী এবং বাড়ীর বাইরে ভ্রমনে থাকা সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহচর্য, হযরত ফারুকে আযম উমরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সর্বোপরি তার নিজের অনুসন্দিৎসা তাকে ইসলামী জ্ঞানের সমুদ্রে পরিণত করেছিল। কুরআন, হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি শাস্ত্রে তিনি ছিলেন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। সেকালে মদীনার যে সকল মনিষীকে বলা হতো ইলম ও আমলের ‘মাজমাউল বাহরাইন’ বা দুই সমুদ্রের সঙ্গম স্থল, ইবনে উমার ছিলেন তাদের অন্যতম।

 

হযরত ইবন উমারের মাধ্যমে ইলমে হাদীসের বিস্তর অংশ প্রচারিত হয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.) ওফাতের পর (৬০) বছরের বেশী সময় জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময় তিনি একাগ্রচিত্তে ইলমে দ্বীনের চর্চা করেছেন। ইবন শিহাব জুহরী বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবীদের কোন বিষয় ইবন উমারের অজানা ছিলনা।’ জ্ঞানের ঐ চর্চা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কোন সরকারী দায়িত্ব তিনি তখনও গ্রহণ করেননি। তার স্থায়ী ‘হালকায়ে দরস’ বা শিক্ষার আসর ছিল মদীনায়। হজ্জের মৌসুমে ফাতওয়া দিতেন। মানুষের বাড়ীতে গিয়েও তিনি হাদীস শুনাতেন।

 

বর্ণিত আছে, একদিন তিনি আবদুল্লাহ ইবন মুতী’র বাড়ীতে যান। আবদুল্লাহ তাকে বসতে দিলেন। বসার পর উমার বললেন, তোমাকে একটি হাদীস শোনানোর জন্য আমি এ সময় তোমার এখানে এসেছি। আর তা হলো রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে দূরে থাকবে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উঠবে যে তার কাছে কোন প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি একতাবদ্ধ ভ্রাতৃময় দল থেকে পৃথক হয়ে মৃত্যুবরণ করলো সে যেন জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো।

 

এখন আরবী জমাদিউস সানি মাস চলছে। এ মাসের ১১ তারিখ তার ওফাত সংঘটিত হয়েছিল। আজ আমরা তাকে স্মরন করি শ্রদ্ধা জানাই। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে তাদের মত আদর্শ পুরুষের শূন্যতা আমাদের দারুনভাবে পীড়িত করে। একজন বিখ্যাত ও বিশুদ্ধ হাদীস বর্ননাকারী রাবী হিসেবে ইবনে উমর দুনিয়া জুড়ে মুহাদ্দেসীনে কেরামের একটি প্রিয় নাম। আজ এখানে তার বর্ণিত ২/১ টি হাদীস উদ্ধৃত করছি। যেমন, তিরমিজি শরীফের ২৬৫৭ হাদীস, ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী (সা.) পেশাবরত অবস্থায় তাঁকে সালাম দিল। কিন্তু নবী (সা.) তার সালামের জবাব দেননি। অর্থ্যাৎ এ ধরনের সময়ে সালাম বিনিময় হুজুর (সা.) এর পছন্দ ছিল না। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে।

 

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : একদা আমি নিদ্রিত ছিলাম, এ সময় আমার কাছে এক পেয়ালা দুধ আনা হল। আমি তা থেকে পান করলাম এবং অবশিষ্টাংশ উমারকে দিলাম। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এর কি তাবীর (ব্যাখ্যা) করেন? তিনি বলেন, ইলম বা জ্ঞান।

 

অন্যত্র আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখলো সে আমাকেই দেখলো। কেননা শয়তান আমার রূপ (সাদৃশ্য) ধারণ করতে পারে না (ইবনে মাজাহ)। তিনি আরো বলতেন, তুমি জ্ঞানী অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করবে না (বুখারী, মুসলিম)। হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে।

 

এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কিসে হজ্ব ওয়াজিব হয়? তিনি বললেন : পাথেয় ও বাহন (থাকলে)। প্রিয় হযরত (সা.) তার সাহাবী সহচরদের আকাশের তারার সাথে তুলনা করেছেন। আমরা নবীজীর এ জ্ঞানী সাহাবার জীবন অনুসরন করব। আর অধ্যয়ন করব তার বর্নিত বিশাল হাদীস ভান্ডার।

 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট