চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

মূসা নবীর (আ.) সফরসঙ্গী ইউশা ইবনে নূনের (আ.) বীরত্বগাঁথা

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১২:১৫ অপরাহ্ণ

হযরত মূসা কালীমুল্লাহর (আ.) ইন্তেকালের পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, হযরত ইউশা ইবনে নূন (আ.)। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে তার আলোচনা, বীরত্বগাঁথা ও শিক্ষাপদ নানাবিষয় উল্লেখিত হয়েছে। তিনি প্রায়সময় হযরত মূসার (আ.) খাদেম হিসেবে তার সাথে থাকতেন।

 

তার জীবনী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না, তবে অনেকের মতে, তার খেলাফত আমলে পবিত্র ভূমি বায়তুল মোকাদ্দাস বনী ইসরাঈলদের দখলে আসে। বর্তমান সময়ে যা নিয়ে প্যালেস্টাইন ও ইসরাঈলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘাত চলছে। বনী ইসরাঈলদের তীহ উপত্যকায় চল্লিশবছর অতিবাহিত হওয়ার পর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদেরকে এবং অন্যান্য উপত্যাকায় যারা তাদেরকে নিয়ে হযরত ইউশা (আ.) দু’বার অভিযান চালিয়ে পবিত্র ভূমি উদ্ধার করেন।

 

এ উদ্ধারকালে তাদের সাথে বরকতময় তাবুতটি ছিল। যাতে ছিল হযরত মূসার লাঠি, হযরত হারুনের পিরহান, আকাশ থেকে অবতীর্ণ মান্নার পাত্র এবং অন্যন্যা দ্রব্যাদি। বর্ণিত আছে হযরত ইউশা (আ.) সাইনা প্রান্তর হতে বের হয়ে সর্বপ্রথম আরীহার দিকে অগ্রসর হন। আরীহা বা বায়তুল মোকাদ্দাস দীর্ঘসময় অবরোধ করে রাখার পর তা জয় করার সময় যখন নিকটবর্তী হল তখন ছিল একেবারে দিনের শেষ অর্থাৎ শুক্রবার সূর্যাস্ত হওয়ার নিকটবর্তী সময়। আল্লাহর নবী দেখলেন, সূর্য যদি ডুবে যায় এবং শনিবারে রাত এসে পড়লে তখন আর লড়াই করা যাবেনা। (কারণ শনিবার ছিল তা’যীম-সম্মান ও উপাসনার দিন)।

 

অতএব, আল্লাহর নবী দোয়া করলেন : হে আল্লাহ! সূর্যকে থামিয়ে দাও।” তিনি আবার সূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন; হে সূর্য! তুমিও আল্লাহর হুকুম মেনে চল আর আমরাও আল্লাহর হুকুম মেনে চলছি; তাই আমাদের কাজে বাঁধার সৃষ্টি করবেনা।’ তিনি ইচ্ছা করলেন যেন শনিবার আসার পূর্বেই আল্লাহর দুশমনদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা যায়। তখন আল্লাহ তা’য়ালা সূর্য থামিয়ে দিয়ে দিনকে একঘণ্টা দীর্ঘ করে দিলেন। ফলে খোদাদ্রোহীকে হত্যা করে সাম্রাজ্য নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসলেন (খাযেন)।

 

আল্লামা ইবনে আসির বলেন- হযরত মূসা (আ.) নিজের জীবিতকালেই পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্য হযরত ইউশা (আ.)-কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন এবং বণী ইসরাঈলকে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত করে প্রত্যেক গোত্রের সেনাপতির নাম ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। সুতরাং হযরত ইউশা (আ.) এর এ ব্যাপারটি হযরত উসামা (রা.)-এর ব্যাপারের অনুরুপ ছিল।

 

নবী করীম (স.) স্বীয় পবিত্র জীবনকালেই শাম (সিরিয়া) দেশ অধিকার করার জন্য হযরত উসামা (রা.)-কে প্রধান সেনাপতি মনোনিত করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী যাত্রা করার পূবেই নবী করীম (স.) ইন্তেকাল করলেন। অতপর হযরত আবু বকর (রাদি.) নিজ খেলাফতকালে সর্বপ্রথম শামের দিকে অভিযান পাঠান।

 

পরিশেষে এ অভিযানই রোম-ইরাক এবং ইরান বিজয়ের সূচনা বলে প্রমাণিত হলো। যার সেনাপতি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স.) এর নির্ধারিত করে যাওয়া হযরত উসামা (রা.)। অনুরুপভাবে হযরত মুসা (আ.) পবিত্র ভূমি হতে অত্যাচারী শক্তিগুলোর মূলৎপাটনের জন্য আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইউশা (আ.) কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে প্রাথমিক কার্যসমূহ সম্পন্ন করেছিলেন।

 

কিন্তু সেনাবাহিনী যাত্রা করার পূর্বেই ইউশা (আ.) কে নবুয়াতের মর্যদা দান করলেন, তখন তারই হাতে অবশেষে পবিত্র ভূমি অত্যাচারী মুশরিক শক্তিগুলো হতে পবিত্র হয়েছিল। হযরত মূসা ও হারুনের (আ.) পরেই তাওরাতে ইউশা ইবনে নূনের উল্লেখ অধিক পরিমাণে এসেছে। তিনি হযরত মূসা (আ.) জীবনকালে তার খাদেম ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি খলিফা নিযুক্ত হন এবং নবুয়াতের স্থলাবর্তী হন। কেনআনে অত্যাচারী মুশরিক কাওমগুলোর অবস্থাবলীর পরিবর্তনে যারা অগ্রণী ছিলেন তন্মধ্যে তিনিও একজন।

 

হযরত মূসা (আ.) যখন বণী ইসরাঈলকে সে কাওমগুলোর সাথে জিহাদের আহ্বান ও উৎসাহ প্রদান করলেন আর তারা অস্বীকার করলো, তখন তিনিই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি বণী ইসরাঈলদের হিম্মত ও সাহস প্রদানের চেষ্টা করেছিলেন এবং আল্লাহর ওয়াদা স্বরণ করায়ে দিয়ে জিহাদের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বলেছিলেন- “যদি তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও তবে তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত” (সূরা মায়েদা-২৩)।

 

স্মর্তব্য, হযরত ইউশা (আ.) বণী ইসরাঈলদের বারো গোত্রের মধ্যে হযরত ইউসুফের (আ.) গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন; যেমন ঐতিহাসিকগণ তার বংশ পরম্পরা এরুপ বর্ণনা করেন : ইউশা ইবনে নূন ফারাহীম ইবনে ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম (আ.)। আল্লাহর এক বিচিত্র প্রদর্শনী যে, যেই ইউসুফ নবী (আ.) এর বদৌলতে কেনআন হতে মান-মর্যাদার সাথে হিযরত করে ইয়াকুব পরিবার মিসরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল, আজ তারই পৌত্র ইউশা (আ.) এর নেতৃত্বে সে খান্দানই পুনরায় নিজেদের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি কেনআনে সেই মান-মর্যাদা ও প্রতাপের সাথে প্রবেশ করেছে। এ থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি যে, যার আমল ও খুলুসিয়াত, ত্যাগ তৃপ্তি ও কোরবাণী আল্লাহ তায়ালার সাথে গভীর প্রেম পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তার জন্য বাতিলের বড় শক্তিও তুচ্ছ এবং অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে।

 

হযরত ইউশা (আ.) এর জিহাদী মনোভাব তার বাস্তব প্রমাণ। এছাড়া যমীনের কিম্বা রাজ্যের উত্তরাধিকার সে কাওমেরই প্রাপ্য, যারা নিঃস্ব নিঃসম্বল হয়েও নির্ভীক দৃঢ় সংকল্প ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সর্বপ্রকার বাঁধা বিপত্তির মোকাবিলা করে থাকে এবং ধৈর্য্যরে সাথে আল্লাহপাকের সাহায্যের ভরসা করে চেষ্টা ও পরিশ্রমের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকে। হযরত ইউশার জীভন গাঁথা তারই প্রকৃষ্ট ঐতিহাসিক প্রমান। আজ এ অসত্যের সয়লাবে যেখানে গোটা বিশ্ব নিমজ্জিত, সেখানে দৃঢ়চেতা সত্যের নিশান বরদারদের সুসংঘটিত হওয়া একান্তই সময়ের দাবী।

 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট