চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে বিপদ-আপদে এগিয়ে আসেন তারা

৪ ডিসেম্বর, ২০২২ | ৩:০০ অপরাহ্ণ

‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও। তার মত সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও’। কামিনী রায় তার ‘সুখ’ কবিতায় এভাবেই নিজে অন্যের মাঝে সুখ খুঁজে পেয়েছেন। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই এই ধরনের মানসিকতা থাকা উচিত। একজনের বিপদে-আপদে কিংবা অসহায় মুহূর্তে সহযোগিতা করতে পারার মাঝে কি যে সুখ তা কেবল নিঃস্বার্থ উপকারী মানুষই বলতে পারেন। সমাজে যাদের পরিচয় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। কথায় আছে, যাঁরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেন তাঁরা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান’। শুধুমাত্র নিজের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিপদগ্রস্থ অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের উদ্দেশ্য পরিবার ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে আলোকিত সমাজ গঠনে কাজ করা।

আগামীকাল (৫ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বরের অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালনের জন্য সকল রাষ্ট্রকে আহবান জানানো হয়। তারই ধারাবাহিকায় প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বব্যাপি স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালিত হয়ে আসছে। জীবনের সর্বত্র স্বেচ্ছাসেবীদের অবদান সম্পর্কে গণসচেতনতা এবং ঘরে-বাইরে স্বেচ্ছাসেবায় অধিক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদান, আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)

 

সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে কাজের ধরন, বেড়েছে ক্ষেত্র। এক সময় পারিবারিক সীমাবদ্ধতার মাঝেও এলাকার উঠতি বয়সের তরুণরা সংগঠিত হয়ে শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চাসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিকভাবে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতো। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে তরুণরা প্রযুক্তিগত সুবিধায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে নিজ এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে সহজে একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং মতের মিলের কারণে বহুমূখী সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে করে একে অপরের সহায়তায় ভালো কিছু উদ্যোগ উঠে আসছে। স্বেচ্ছাসেবীরা সম্পর্ক খোঁজেন না, দল-মতের উর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে অন্যের বিপদে হাত বাড়িয়ে দেন। এতেই একজন স্বেচ্ছাসেবকের মানসিক প্রশান্তি। ইবাদতেরও অংশ বটে।

উল্লেখ না করলেই নয়- রক্তশূন্যতায় যখন একজন রোগীর জীবন সংকটাপন্ন, তখন স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সময়ের তোয়াক্কা না করে হাসপাতালে ছুঁটে যান নিজের রক্ত দিয়ে রোগীকে বাঁচাতে। দূর্যোগকালীন মুহূর্ত, বন্যা কবলিত কিংবা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়াতে, তাদের জন্য খাবার, বস্ত্র, গৃহ সামগ্রী পৌঁছে দিতে, নদী ভাঙ্গনে বাঁধ নির্মাণ বা এলাকার রাস্তা সংস্কারে স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞান প্রদান, ঝরে পড়া শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ, শীত মৌসুমে বস্ত্র বিতরণ, ধর্মীয় উৎসবে নতুন কাপড় ও খাবার সামগ্রী বিতরণ, অসহায় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা, মৃত ব্যক্তির সৎকার, হাসপাতালে অজ্ঞাত রোগীর সেবা শুশ্রুষা, অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে না পারা মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ, পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপন ও পরিচর্যা, সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, বাল্য বিবাহ, যৌতুক ও মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনসহ সময়োপযোগী নানামুখী মানবিক উদ্যোগে এই স্বেচ্ছাসেবীরাই লড়ে যাচ্ছে।

 

অতিসম্প্রতি মহামারী নোভেল করোনা ভাইরাসের কারণে ঘর থেকে বের হতে বিধি-নিষেধ ছিলো। সাধারণ মানুষের আয় রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল, দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ, রাস্তার ধারে অনাহারে কাটিয়ে দেওয়া পরিবারগুলো কেমন কেটেছে তা তো কম-বেশি কারোই অজানা নয়। তাদের খোঁজখবর রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় সেবাসংস্থার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরা নিজ উদ্যোগে নিজের জীবনবাজি রেখে দিনের পর দিন অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এমন দূর্যোগময় মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগের হাজারো গল্প কারো চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। করোনাকালীন ও তৎপরবর্তী সময়ে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি এমনই অনেক সংগঠনের কথা না বললেই নয়; বিশেষ করে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, সম্মিলিত সামাজিক সংগঠন পরিষদ, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল, বিএইচআরসি, মানবিক হাসপাতাল, নিষ্ঠা ফাউন্ডেশন, সচেতন তরুণ প্রজন্ম, আল মানাহিল, মানবিক পাথরঘাটা, মুসাইদা ফাউন্ডেশন, হেলথ বিডিসহ আরো জানা-অজানা সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছায় যে কার্যক্রম করছে তা চিরকাল অনন্য নজির হয়ে থাকবে।

প্রকৃতঅর্থে আমরা যা বুঝি, অহংকার ও লোভ কখনই একজন প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবীকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ তারা অন্যের জন্য নিজের অর্থ-সময়-শ্রম উৎসর্গ করে। জীবন ও জগত সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস থেকেই তারা অন্যের অধিকার পূরণে এগিয়ে যায়। একজন স্বেচ্ছাসেবক নিজের ইচ্ছায় পরের উপকার করতে গিয়ে বাহবা যেমন পায় আবার ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক কথাও শুনতে হয়। সবরকম পরিস্থিতির জন্যই একজন স্বেচ্ছাসেবককে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়।

 

মানুষ হিসেবে জীবনকে উপভোগ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সকলেরই বাস্তবমুখী শিক্ষার জন্য সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ জরুরী। চারপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই এ শিক্ষা অর্জন সম্ভব। যে শিক্ষা নিজের মাঝে জাগিয়ে তোলে নৈতিকতা। দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজের প্রতিভা, চরিত্র ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে নিজেকে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তোলে। সমাজের অন্যায়-অনাচার, অপরাধবোধ পরিহারে নিজের মাঝে শুদ্ধ মানসিকতা গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখে। কাজেই, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষই নিজের মানবিকতার কারণে স্বেচ্ছাসেবী চেতনায় জাগ্রত হন। যার জন্য বয়স, পেশা কখনই প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়না। শারিরীকভাবে সামর্থ্যবান যেকোন ব্যক্তিই তার জন্য উপযুক্ত। পৃথিবীতে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি নিঃস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁদের কর্মযোগ্য আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রাণিত।

পরিশেষে, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ এই অমর বাণীটি বুকে ধারণ করে একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি এবং শ্রদ্ধাশীল মনোভাব, ইতিবাচক চিন্তা-চেতনায় সকলে একযোগে যার যার অবস্থান থেকে মানবাধিকার সুরক্ষায় দেশ ও দশের কল্যানে কাজ করতে পারাটাই আজকের এই স্বেচ্ছাসেবী দিবসের স্বার্থকতা। সকল স্বেচ্ছাসেবকদের নিরলস শ্রমের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা।

লেখক : সামাজিক সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী।

 

পূর্বকোণ/এএস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট