চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সূরা নিসা’য় নারীর অধিকার ও সামাজিক ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ শিক্ষা

২৫ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

কুরআনুল করীম অতি পবিত্র গ্রন্থ। আমাদের প্রিয় নবী আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর শ্রেষ্ঠতম মুজিজা বা অলৌকিক নির্দশন এ কুরআন। এখানে আছে চোখের শান্তি, আত্মার শান্তি, এমনকি সমাজকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার পয়গাম। কালের পরিবর্তনে কুরআনে শরীফের ভাষাগুলো কত বেশী কার্যকর তা পাঠ করলেই বুঝা যায়।

 

আজ আমরা এ-কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরার পটভূমি নিয়ে আলোচনা করবো। সুরাটির নাম সুরা নিসা। এটি কুরআনের চতুর্থ সুরা। মদীনায় অবতীর্ণ এ সূরার আয়াত বা বাক্য সংখ্যা ১৭০। মহানবীর (স.) যুগে ক্রমবর্ধমান যুগ জিজ্ঞাসার জবাব হিসেবে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। এখানে এমন কতিপয় আইন-কানুনের সন্নিবেশ করা হয়েছে যা শুধু সে যুগে নয় আজকের যুগেও দেশ, বিদেশের আইন-আদালতে বিদ্যমান এবং সময়োপযোগী কানুন হিসেবে সমাজের শৃংখলা বিধানে সহায়তা করে যাচ্ছে। ‘নিসা’ অর্থ নারী। এ সূরায় ‘নিসা’ শব্দটি আছে বলে এ নামকরণ করা হয়।

 

অবশ্য, নারী সমাজের নামে এ পূর্ণ সূরাটি নামকরণের মাধ্যমে তাদের ব্যাপারে ইসলাম ও তার মহানবীর (স.) ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। পূর্বেও সূরা আলে ইমরানে বিভিন্ন যুদ্ধ-জেহাদ, শত্রুপক্ষের সাথে আচার আচরণ, যুদ্ধলব্ধ বস্তুসামগ্রীর (গনীমতের মাল) অপচয় ও আত্মসাতের ভয়াবহ পরিমাণ প্রভৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। আর আলোচ্য সূরার শুরুতে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যের অধিকার সংক্রান্ত বিধান জারি করা হয়েছে। যেমন অনাথ-এতিমের, আত্মীয়স্বজনের অধিকার ও স্ত্রীদের অধিকার প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে।

 

উল্লেখ্য, হক্কুল ইবাদত বা অন্যের অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন কতোগুলো অধিকার রয়েছে যেগুলো সাধারণত দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় পড়ে এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা কার্যকর করা যেতে পারে। সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া ও শ্রমের মজুরী প্রভৃতি এ জাতীয় অধিকার যা মূলত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে কার্যকর হয়ে থাকে। এসব অধিকার যদি কোন এক পক্ষ আদায় করতে ব্যর্থ হয় অথবা সেক্ষেত্রে কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তাহলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তার সুরাহা করা যেতে পারে।

 

কিন্তু সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, কারো নিজ বংশের এতিম ছেলেমেয়ে এবং আত্মীয়স্বজনের পারস্পরিক অধিকার আদায় হওয়া নির্ভর করে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার উপর। এসব অধিকারকে পাল্লায় তুলে মাপা যায় না। কোন চুক্তির মাধ্যমে তা নির্ধারণ করাও দুষ্কর।

 

সুতরাং এসব অধিকার আদায়ের জন্য আল্লাহ-ভীতি এবং পরকালের জবাবদিহিতার মানসিকতা ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন উত্তম উপায় নেই। আর এ গুণকেই বলা হয়েছে ‘তাকওয়া’। বস্তুত এ তাক্ওয়া দেশের প্রচলিত আইন ও প্রশাসনিক শক্তির চেয়ে অনেক বড়। তাই আলোচ্য সুরাটি তাক্ওয়ার বিধান দিয়ে শুরু হয়েছে, বলা হয়েছে ইয়া আইয়্যুহাননাস ইত্তাকু রাব্বাকুম..। অর্থাৎ হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার বিরুদ্ধাচরণকে ভয় কর। সম্ভবত এ কারণেই আ-হযরত (স.) বিয়ের খোৎবায় এ আয়াতটি পাঠ করতেন আজো বিয়ের খোৎবায় এটি পাঠ করা সুন্নত।

 

পটভূমির দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখি, এই সূরাটি বিভিন্ন ভাষণের সমন্বয়। এটি সম্ভবত তৃতীয় হিজরী সনের শেষভাগ হতে শুরু করে ৪র্থ হিজরীর শেষ কিংবা ৫ম হিজরীর প্রথম ভাগ শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অবন্তীর্ণ হয়েছে। কুরআন বিশেষজ্ঞগণ এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট আদেশ ও ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে এগুলোর অবতীর্ণ হবার সময় সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মীরাস বন্টন ও এতিমের হক সম্পর্কীয় বিধান উহুদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়েছে। কেননা এই যুদ্ধেই মুসলমানদের সত্তরজন লোক শহীদ হয়েছিলেন। মদীনায় এদের এতিম বালক-বালিকাদের সম্পত্তি নির্ধারণের ব্যাপারে তখন এক প্রকট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। সূরায় প্রাথমিক চারটি রুকু ও ৫ম রুকুর প্রথম তিন আয়াত সম্ভবত এ সময়েই নাযিল হয়েছিল। পানি না পেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল বনু মুস্তালিক যুদ্ধের সময়। এই যুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল ৫ম হিজরী সনে। কাজেই ৭ম রুকুর যে অংশেই তায়াম্মুমের উল্লেখ করা হয়েছে তা এ যুদ্ধের নিকটবর্তী কোন এক সময়ে নাযিল হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

 

হাদীসের বর্ণনাসমূহে ভয়কালীন সালাত আদায় করার উল্লেখ পাওয়া যায় জা-তুররিকা যুদ্ধ প্রসঙ্গে। এ যুদ্ধ ৪র্থ হিজরী সনে সংঘটিত হয়েছিল এজন্য সুরার ১৫তম রুকুতে যুদ্ধকালীন সালাত আদায়ের রীতিনীতি গুলো তখনকার কোন এক সময়ে নাযিল হয়েছে বলে মনে করা হয়। মদীনা হতে বনু নাজির গোত্রের বহিষ্কার চতুর্থ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ঘটনা। কাজেই এই সূরার যে অংশে ইহুদীদের সর্বশেষ সতর্কবাণী শোনানো হয়েছিল সে অংশ বহিষ্কার ঘটনার পূর্বে কোন এক সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল।

 

এরূপ আলোচনা হতে সমগ্র সূরাটির অবতরণকাল জেনে নেয়ার পর সে সময়কার ইতিহাসটুকু যদি আমাদের সামনে থাকে তাহলে সূরাটি তেলাওয়াত এ বুঝা আমাদের জন্য সহজতর হয়ে পড়বে। এ সময় নবী করীম (স.) এর সামনে যে বিরাট কাজ ছিল তা মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়- ১) হিজরতের পর মুসলমানরা যে নয়া জিন্দেগীর স্বপ্ন নিয়ে একত্রিত হচ্ছিল তার বিকাশদান এবং জাহেলী তাহজিব তামাদ্দুন ক্রমাগত অপসারিত করে সর্বক্ষেত্রে ইসলামী ভাবধারার উন্মেষ ঘটানো। ২) আরবের মুশরিক-ইহুদী উপজাতি ও মুনাফিকদের যে সংস্কারবিরোধী অপতৎপরতা ছিল তা মুকাবেলা করা। ৩) হাজারো বিরুদ্ধতা পদদলিত করে দাওয়াতকে সম্প্রসারিত করা এবং গণমানুষের কাছে ইসলামকে ক্রমাগত আকষর্ণীয় করে উপস্থাপন করা।

 

আগেই বলেছি, এ সূরায়ে ঐসব আইন-কানুনেরই বিস্তারিত আলোচনা এসেছে যা পূর্ববর্তী সূরাসমূহে সংক্ষিপ্ত আকারে ধারণা দেয়া হয়েছিল। পারিবারিক জীবন, বিয়ে শাদী, অন্যের অধিকার, এতিমের সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক ধারণা তুলে ধরা হয়েছে এ সূরা নিসায়। একইসাথে আহলি কিতাবসহ মুনাফিকদের সত্য লুকানো কপট আচার আচরণের সমালোচনা করে প্রকৃত সত্যিকারের ঈমানদারীর পরিচয় কি হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

 

এ সূরায় মুসলমানদের বিপদ সংকুল অবস্থায় সাহসের উপকরণ, বিপদকালীন ইবাদত ও পানির অভাবে অজু গোসলের কোন সুযোগ না থাকলে তায়াম্মুমের বিধান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষ করে তখনই বেদ্বীন বেষ্টিত হওয়ার কারণে ঈমান আক্বীদা ও অস্তিত্ব রক্ষা হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়ে তখন দারুল ইসলামে হিজরতেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

 

মদীনার ইহুদীদের মধ্যে বনু নাজীর গোত্রের আচরণ বিশেষভাবে শত্রুতামূলক ছিল তারা সম্পাদিত চুক্তিসমূহ প্রকাশ্যভাবে ভঙ্গ করে ইসলামের দুশমনদের সাথে হাত মিলিয়েছিল এখানে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট সতর্ক ও বিধান দেয়া হয়। সে সমাজের মুনাফিকরা আবার বিভিন্ন উপদল, বিভিন্ন কর্মনীতিতে বিভক্ত ছিল ফলে, কোন ধরনের মুনাফিকের সাথে কি ধরনের ইনসাফভিত্তিক আচরণ করতে হবে তার বিশ্লেষণ এসেছে এখানে।

 

সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল মুসলমানদের চরিত্র নির্মল করা কেননা এই সাংঘাতিক একমাত্র উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নেই পরিত্রাণ লাভ করা সম্ভব হতে পারে আজ দেশে দেশে মুসলমানদের চরিত্র কি ভাল? তাদের আচার আচরণ ও বৈশিষ্ট্য কি অন্যদের আকর্ষণ করে? মোটেই না মুসলমানরা আজ, স্বকীয়তাহারা, ঐতিহ্যবিচ্যুত, আজ মুসলিম চরিত্র আর মুনাফিক চরিত্রের মাঝে কোন সীমানা দেখা যাচ্ছে না।

 

অথচ ইসলামের সোনালী যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো সেখানে মুসলিম কারা আর মুনাফিক কারা তা চিহ্নিত হয়ে থাকতো। যে কোন সমাজে মুনাফিক, কুচক্রী, অসৎদের, যদি চিহ্নিত করা না হয়, যারা সৎ ও কল্যাণকামী এবং সর্বোপরি আদর্শবাদী তারা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়। এ জন্য কুরআনের দেয়া আলোকধারা গড়তে হবে জীবন, গড়তে হবে সমাজ, উজ্জীবিত করতে হবে সভ্যতা।

 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট