চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাহে রবিউস সানির ফজিলত ও আমল

১১ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামি হিজরি সন ও আরবি বর্ষপঞ্জির চতুর্থ মাস রবিউস সানি। একে রবিউল আখিরও বলা হয়। এটি রবিউল আউয়াল মাসের জোড়া মাস। রবি অর্থ বসন্ত, আউয়াল অর্থ প্রথম, সানি অর্থ দ্বিতীয়, আখির অর্থ শেষ অন্য বা ভিন্ন। রবিউস সানি অর্থ হলো বসন্তকালের দ্বিতীয় মাস বা অন্য বসন্ত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুনিয়াতে আগমনের মাস হিজরতের মাস ও তিরোধানের মাস রবিউল আউয়ালের জোড়া মাস হিসেবে রবিউস সানি মাসও বেশ তাৎপর্যমণ্ডিত। রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ বড় পীরখ্যাত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর ওফাত দিবসকে ফাতিহায়ে ইয়াজ-দাহম অর্থাৎ ১১ তারিখের ফাতিহা পাঠ অনুষ্ঠান বলা হয়। নামাজ, রোজা ও দরুদ শরিফের মতো ফাতিহায়ে দোয়াজ-দাহমও ফারসি ভাষা থেকে এসেছে।

 

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম বলতে রবিউস সানি মাসের এগারো-এর ফাতেহা শরিফকে বোঝায়। এই পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম শরিফ ইমামুল আউলিয়া পীরানে পীর গাউসুল আযম দস্তগীর হজরত মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানি (র.)-এর স্মরণে পালিত হয়। মহামহিম রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতের প্রকাশ সময় বা কাল। সময়ের প্রকৃতি আল্লাহর দান। বিষয়, বস্তু, ব্যক্তি ও স্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করে সময়কে বিশেষ পরিচয়ে বিশেষায়িত বা সংজ্ঞায়িত করা হয়। ব্যবহারিক সুবিধার্থে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ, নক্ষত্র নানা প্রাকৃতিক, জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে সময়ের হিসাব বা ধারণা প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা কোরআন মাজিদে বলেন সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমতো চলে। কালের গ্রোতে সময় গড়িয়ে যায় ; আয়ু ক্ষয় হয়, বয়স বৃদ্ধি হয়।

 

 

সময়কে কাজে লাগানো বা সময়ের সদ্ব্যবহারই জীবনের সফলতা এবং সময়ের অপচয় বা অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। আল্লাহতাআলা বলেন সময়ের শপথ! মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে; তবে তারা নয়—যারা বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে এবং সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। সময় জীবনের মূলধন বা পুঁজি। সময় অমূল্য সম্পদ। একে কর্মের মাধ্যমে মূল্যবান ও মূল্যায়ন করতে হয়। আমলের পসরার মাধ্যমে একে লাভজনক করতে হবে। না হলে কালের আবর্তের নিপতিত ও নিমজ্জিত হতে হবে। তিলে তিলে হিসাব দিতে হবে প্রতিমুহূর্তের। দুনিয়ার স্বল্প সময়ের ক্ষুদ্র আমলও পরকালের অনন্ত সুখের কারণ হবে।

 

 

আল্লাহ তাআলা বলেন কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে ; আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তা-ও সে দেখতে পাবে। (সুরা-৯৯ যিলযাল,আয়াত : ৭-৮)। বিশেষ সময়ের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত আছে কোরআন ও হাদিসে। যেমন রমজান মাস, জিলহজ মাস ও হজের তিনটি মাস, মহররম মাস ও আশহুরে হুররুম বা হারাম ও সম্মানিত চারটি মাস এবং রজব মাস ও শাবান মাস। সপ্তাহের শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার। বছরের বিশেষ রাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শবে কদর, শবে বরাত, ঈদের রাত ইত্যাদি। কিন্তু এসব ফজিলতপূর্ণ সময়ে কেউ যদি ফজিলতপ্রাপ্তির আমল না করেন, তবে তা তাঁর জন্য ক্ষেত্রবিশেষ ক্ষতির কারণই হবে। যেমন, রমজান পেয়ে ক্ষমাপ্রাপ্তি লাভে ব্যর্থ ব্যক্তির জন্য নবী করিম (সা.)-আল্লাহর অভিশম্পাতে সম্মতি দিয়ে আমিন বলেছেন।

 

সাধারণ সময়ও বান্দার ইখলাস ও তাকওয়াপূর্ণ সুন্নাহভিত্তিক নেক আমল ও ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শুভ উদ্যোগ ও সফল সার্থক অবদানের কারণে অসাধারণ পুণ্যময় হয়ে ওঠে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি আমল কখনো পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হলো তাহাজ্জত নামাজ, প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদ—এর রোজা পালন ও রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ।

 

রবিউস সানির নতুন চাঁদ দেখে যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর দুই রাকাত করে মোট ৮ রাকাত নফল নামাজ পড়বে এবং প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার সঙ্গে সূরা ইখলাস। কোনোটাতে আছে যদি কোনো ব্যক্তি এ মাসের শেষ রাতে দুরাকাআত করে চার রাকাআত নফল নামাজ এ নিয়মে আদায় করে আবার কোনোটাতে বর্ণিত আছে যে এ মাসের প্রথম থেকে সূরা মুজ্জাম্মিলের আমল করবে তার খুবই উপকার হবে ইত্যাদি। জাওয়াহেরে গায়েবী কিতাবে আছে এ মাসের প্রথম তারিখের রাত্রে চার রাকাত নফল নামায আদায় করলে ৯০ (নব্বই) হাজার বছরের ছাওয়াব পাওয়া যায় ও ৯০ (নব্বই) হাজার বছরের গুনাহ মাফ হয়। নিয়ম : প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাছ পড়তে হয়।

 

 

নবীজি (সা.)-প্রায়ই প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করতেন। কারণ এই দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবারে জন্মগ্রহণ ও ওহি প্রাপ্তির শুকরিয়াস্বরূপ তিনি এই আমল করতেন। আমল দ্বারা সময়কে ঋদ্ধ করা ও জীবনকে সমৃদ্ধ করা জ্ঞানীর কাজ। রাসুলে আকরাম (সা.)-বলেছেন তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো-যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে,সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে। প্রিয়নবী (সা.) এ দুদিন রোজা রাখার গুরুত্ব বর্ণনা করে ঘোষণা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহ তায়ালার দরবারে) আমল পেশ করা হয়।

 

 

সুতরাং আমার আমলসমূহ যেন রোজা পালনরত অবস্থায় পেশ করা হয় ; এটাই আমার পছন্দনীয়। আয়িশা (রা.)-বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজার প্রতি বেশি খেয়াল রাখতেন। তাওয়াবিনদের বিপবি আন্দোলন : সন ৬৫ হিজরির ১লা রবিউস সানি উক্ত দিনে সুলাইমান বিন সুরাদের নেতৃত্বে প্রায় ১৬ হাজার তাওয়াবিন যারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল। সুলাইমান বিন সুরাদ ছিল ইমাম আলি (আ.)-এর অনুসারি। সে বিভিন্ন যুদ্ধে ইমাম আলি (আ.)-এর পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পরে আয়নুল ওয়ারদা নামক স্থানে ইবনে যিয়াদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার সময় ৯৩ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন এবং তার সেনাদের মধ্যে মাত্র ২৭ জন যারা আহত হয়েছিল শুধুমাত্র তারা ব্যাতিত সকলেই শাহাদত বরণ করে। রবিউস সানি মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রবিউস সানি মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।

 

 

পরিশেষে, আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা ! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। আল্লাহপাক আমাদের এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ রবিউস সানি মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ,ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও রবিউস সানি মাসে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। প্রতিটি মাসের শুরু এবং শেষ বিশেষ দোয়া-কালাম ও নামাজ, রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করা নবীজি (সা.)-এর সুন্নাত। আমল দ্বারা সময়কে রঙিন করা ও জীবনকে সাজানো বুদ্ধিমানের কাজ। সকলকে কবুল করুক আমিন।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী ইসলামি চিন্তক।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট