চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডাইনিং টেবিল

৪ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আমার খুব শখ ছিল একটা আট আসনের ডাইনিং টেবিলের। বেশিরভাগ বাড়িতে ছয় আসনের ডাইনিং টেবিল দেখতে পাওয়া গেলেও বারিধারায় নিজের বাড়ি করার পর আমার একটা আট আসনের টেবিল কেনার খুব ইচ্ছে ছিল। আমাদের বাসার ডাইনিং স্পেসটা বেশ বড়। প্রায় ৩০৮ স্কয়ার ফুট। আমার মতে- শহরের একটা বাসার প্রাণকেন্দ্র হল ডাইনিং স্পেসটা। কল্পনায় ছিল কোন একসময় তিন ছেলেকে বিয়ে করাবো। তিন পুত্র, তিন পুত্রবধূ আর আমরা দু’জন এক টেবিলে বসে খাবো। সারাদিন পর অন্তত রাতের খাবারটা একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবো আর নানারকম গল্প করবো।

আমার আব্বা খুব শৌখিন লোক ছিলেন। আমাদের বাড়িতে ছিল বিভিন্ন রকম ডাইনিং টেবিল। কখনো আয়তকার, কখনো ওপেল শেইপ’র। কিন্তু সবই আট আসনের। একসাথে আটজন তো বসা যেতই প্রয়োজনে দশ জনও বসা যেত। টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। আব্বা-মা, ভাই-বোনরা। ফর্মাল ডাইনিং রুম ছাড়াও কিচেন লাগোয়া একটা প্যান্ট্রি কাম ডাইনিং ছিল। সেখানে ছিল ছয় জনের টেবিল।

তার বেশ অনেক পরে আমার বড় আপার মোহাম্মদপুরের বাসায় দেখেছি আট আসনের টেবিল। একান্নবর্তী পরিবার। বড় আপার সাত ছেলে-মেয়ে, জামাই, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি মিলে কত মানুষ। সারাবছর মেহমান তো ছিলই। বড় দুলাভাই ছিলেন অতিথি পরায়ণ। নিজে খেতে পছন্দ করতেন, মানুষকেও খাওয়াতে পছন্দ করতেন। স্বার্থক ওনাদের সেই ডাইনিং টেবিল।

আমার বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন সেনানিবাসে ছয় জনের ডাইনিং টেবিল আর কাঠের চেয়ার যেটার পিছনের অংশ বেত দিয়ে বাঁধানো ব্যবহার করেছি বেশ কয়েক বছর।

১৯৯৭ সালে কর্তার অবসরগ্রহণ এর পর সেনানিবাসের ফুল ফার্নিসড বাসা ছাড়তে হল। বিয়েতে পাওয়া বাবা মায়ের দেয়া কিছু আসবাব নিয়ে ভাড়া বাসায় ওঠলাম। সেইসময় একসাথে অনেক কিছুরই প্রয়োজন হল। বাচ্চাদের জন্য খাট, সোফা, পড়ার টেবিল, ড্রেসার, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার আরো কত কী। কিন্তু একসাথে এত টাকা পাবো কোথায়? মেজর সাহেবের ব্যাচেলর লাইফে কেনা নিজেদের এক সেট বেতের সোফা ছিল। বোনের কাছ থেকে পেলাম আমার মায়ের দেয়া সদ্য বানানো সেগুন কাঠের একটা ডাবল বক্স খাট। আর পুরনো একটা টেবিল সাথে লক্কর ঝক্কর মার্কা ছয়টা চেয়ার। ওই সময় আমার বোন আমেরিকা চলে যাচ্ছিল। অল্প ব্যবহার করা মায়ের দেয়া নতুন খাট সাথে জাজিম ও তোষক, পুরোন ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার পেয়ে ওই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ফেললাম স্বস্তির নিঃশ্বাস।

২০০১ সালে উঠলাম নিজের নতুন বাড়ি কাশবনে। স্বপ্ন ছিল নতুন বাড়ি নতুন আসবাব দিয়ে সাজাবো। কিন্তু বাড়ি করতেই অনেক টাকা লেগে গেল যে নতুন আসবাব কেনার কথা মাথায়ই আনতে পারলাম না। বোনের দেয়া ডাইনিং টেবিল আর চেয়ারের পায়ের অবস্থা ততদিনে বুড়ো মানুষের দাঁতের মত।

নাহ , এবার ডাইনিং টেবিল আর ছয়টা চেয়ার না কিনলেই নয়। তখনো আট আসনের টেবিল কেনার চিন্তা মাথায় আসেনি। ব্রাদার্স ফার্নিচার থেকে কিনলাম নতুন ডাইনিং টেবিল ও ছয়টা চেয়ার। সুন্দর এবং দাম সাধ্যের মধ্যেই।

টেবিল টা কেনার কয়েক মাস পর একদিন ভাগ্নি জেসমিনের বাসায় বেড়াতে গেলাম। বারিধারায় ওর ডুপ্লেক্স বাড়ি। সুন্দর করে সাজানো। ছিমছাম পরিপাটি। আমার কাছে ওর বাসার সবচেয়ে আকর্ষনীয় যে জিনিসটি লাগল তা হল আট আসনের ডাইনিং টেবিল। সামান্য কারুকার্য করা চৌকোণা টেবিল। উপরে স্বচ্ছ কাঁচ বসানো। টেবিলের চারপাশে দুটি করে মোট আটটি চেয়ার। ভীষণ ভাল লাগল। আমার ছেলেরাও ততদিনে একটু বড় হয়েছে। টেবিলটা দেখে মনে হল ইস আগে দেখলে ঠিক এমনই একটা ডাইনিং টেবিল কিনতাম। ভবিষ্যতে ছেলেরা বিয়ে করবে, তিন তিনটা বউ ঘরে আসবে। ছয়টা চেয়ারে আমাদের হবে না। আটটা চেয়ারই পারফেক্ট।

মাথায় রয়ে গেল আট আসনের ডাইনিং টেবিলের কথা। দিন যায়, বছর যায়। হাউস বিল্ডিং এর লোনের বোঝা মাথায়। আর তিন ছেলের পড়ার খরচ তো আছেই। নতুন কোন আসবাব আর কেনা হয়না। নিজের পুরনো যা আছে তা দিয়েই বাসা সাজালাম। মাঝে মাঝে মনে হত এখন যেভাবে চলছে চলুক। হাতে টাকা আসলেই সব হবে।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। একসময় লোন শোধ হল। খরচও কিছুটা কমে গেল। কিন্তু বাসার মানুষ কমতে শুরু হল। বাড়িতে পাঁচজন মানুষ ছিলাম। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকতে শুরু করলো। ছেলে বিয়ে করার পর ভেবেছিলাম ছয় জনের টেবিলটা এবার পূরণ হবে। তা তো হলোইনা। বরং একটা চেয়ার খালি হয়ে গেল। রইলাম চারজন। এরপর প্রথমে ছোট ছেলে, সপ্তাহখানেক পর মেঝ ছেলেও চলে গেল আমেরিকায়। এখন শুধু দুজন মানুষ। আমার কর্তা আর আমি। ছেলেদের শুন্য আসনের দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভাবি এক এক করে কোথায় চলে গেল ওরা? এক সময় আমরাও হলাম প্রবাসী।

সময়ের দোলাচলে সংসার সুন্দর করে সাজানো হলো না। আমার আফসোসও আর রইলোনা। সাড়ে আট বছর পর ফিরে এলাম নিজের নীড়ে। এতদিনে বয়স বেড়ে গেছে। সাধ আহ্লাদ কর্পূরের মত উড়ে গেছে। কিসের ডাইনিং টেবিল? কিসের সোফা? আর কিসের খাট? কোন কিছুতেই মন নেই।

দশ মাস আগে আমরা দেশে ফিরে এসেছি। দু’দিন আগে মেজ ছেলেও এসেছে। প্রথম যেদিন টেবিলে তিনজন একসাথে খেতে বসলাম কী যে আনন্দ! আমার এই ছেলে সাড়ে আট বছর আমেরিকায় থাকলেও দেশি খাবারের প্রতি ওর আকর্ষণ রয়েই গেছে। ভাত ওর অনেক প্রিয়। তার সাথে পছন্দ পাতলা ডাল, লাল শাক, চিংড়ি মাছ, টমেটোর ভর্তা ইত্যাদি ইত্যাদি ।

গতকাল বড় ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনি বাসায় আসলো। ছয়জনের টেবিল টা এবার পরিপূর্ণ। ভাবছি কবে একসাথে তিন ছেলে, বউমা আর নাতি-নাতনিকে নিয়ে এক টেবিল এ বসবো ? এক বেলার জন্য হলেও কি আমার স্বপ্ন পূরণ হবে ?

লেখক: সালমা আনজুম লতা, বারিধারা, ঢাকা

পূর্বকোণ/আর

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট