চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

৪ নভেম্বর, ২০২২ | ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

হিজরী ৫৬১ সালের ১১ রবিউসসানি আধ্যাত্মিক জগতের এ মহান কৃতীপুরুষ লাখো-কোটি পথহারা মানুষের সত্যের দিশা দানকারী অলীকূল সম্রাটের ওফাত হয়। এ দিনে মুসলমানগণ বিভিন্নধরনের ইবাদত, মাহফিল ও ইসলামী অনুষ্ঠানমালা আঞ্জাম দিয়ে থাকে।

 

জগতখ্যাত ইসলাম প্রচারক সুফিসাধক হজরত বড়পীরের (রহ.) পরিচয় নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তার নাম বাংলার মুসলমানদের মুখে মুখে। তার তরিকার অনুসারী অনুগামী এ অঞ্চলের সর্বত্র। বিশ্বব্যাপী তার প্রবর্তিত তরিকায়ে কাদেরিয়ার পাবন্দ এখন লক্ষ-কোটি মানুষ। বস্তুত কোন অলী আল্লাহই তার মত ইতিহাসের এমন দীর্ঘসময়ব্যাপী ভূগোলের এমন বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আলোচিত অনুসৃত হয়নি।

 

আমরা জানি, আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবাদের পর দুনিয়া ও আখিরাতে সবচেয়ে মর্যাদাবান হলেন আউলিয়ায়ে কেরাম। তাদের ব্যাপারে আল্ কুরআনে এসেছে- সাবধান! নিঃসন্দেহে আল্লাহর অলীদের জন্য কোনধরনের ভয় কিংবা পেরেশানীর অবকাশ নেই- সূরা ইউনুস। মুফতি শাহ আহমদ রেজা খান বেরেলভী (রহ.) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- আল্লাহর অলীগণ আল্লাহর ফরজসমূহ পালনপূর্বক তার আনুগত্যে নিবেদিত হন। তারা প্রভুর মারিফাত সাগরে নিমজ্জিত। কুদরতে ইলাহির শক্তিতে তাঁরা দেখেন। যখন শোনেন শুধু আল্লাহর আয়াতগুলোই শোনেন। যখন কথা বলেন তখন আল্লাহর প্রশংসা করেন। একপর্যায়ে তারা আল্লাহর এতো নৈকট্য লাভে ধন্য হন যে, আল্লাহ নিজেই তাদের রক্ষাকারী, সাহায্যকারী ও মদদগার হয়ে যান।’

 

আউলিয়া ও সুফি দরবেশের অপরূপ পবিত্র জীবনকথা ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং পরম গৌরবের বস্তু। আজ দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের যে বিস্ময়কর প্রচার ও প্রকাশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে আউলিয়া দরবেশগণের নিরবিচ্ছিন্ন মোজাহেদা, ত্যাগ ও চরম আত্মবিলোপ। দুনিয়ায় অগণিত অসংখ্য অলী-আবদালের মধ্যে হযরত বড়পীরের স্থান ও মর্যাদা অতি উর্ধ্বে। আমাদের সুন্দর জীবন গড়ার মানসে তাঁকে জানা ও বোঝা অতীব জরুরী। তাযকেরাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে রয়েছে : একব্যক্তি হযরত বু-আলী দাক্কাক (রহ.) নামক জনৈক মুসলিম মনীষীকে প্রশ্ন করেছিলেন : আমরা যখন আউলিয়া ও মহৎ ব্যক্তিদের উপদেশ আমল করতে পারি না, তখন মাঝে মাঝে শুধু তাদের বাণী শুনে কি লাভ? বু-আলী (রহ.) খুব সুন্দর উত্তর দিলেন।

তিনি বললেন : হাঁ তবুও দু’টি লাভ। তাহলো মহৎ ব্যক্তিদের জীবনচরিত শ্রবণে শ্রোতার মাঝে সৎকাজে সাহস ও খোদাপ্রেম বৃদ্ধি পায়। তার মনের সমুদয় অহংকার আমিত্ব ও দম্ভ চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায় এবং সে ভালমন্দ বুঝতে সক্ষম হয়।

 

‘ও ভাই ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে/গোলাগুলির বারুদে নয় কঠিন ভালবেসে।’ এ শ্লোগান ও চিন্তাধারাই অসংখ্য মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও সাধকদের ভুবনজয়ের পেছনে কাজ করেছিল। বড়পীর ছিলেন এ জয়ের শীর্ষপুরুষ। তিনি ইতিহাসখ্যাত এমন একব্যক্তিত্ব- যিনি তলোয়ার কিংবা কোন দুনিয়াবী শক্তির লাগাম ধরে বিশ্বময় সুনাম অর্জন করেননি। তিনি অকৃত্রিম খোদাপ্রেম, কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণ ইত্তেবা, শরীয়ত ত্বরীকত ও মারিফাতের অফুরন্ত জ্ঞানাহরণ, মাতৃভক্তি, সততা ও সত্যবাদিতার গুণে বিশ্বের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলিম-উলামা, আমীর-উমরাহ, অলী-দরবেশগণেরও অনুসরণীয়- অনুকরণীয় হয়েছেন। তিনি ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে মানুষকে সঠিকপথে আসার আহবান জানাতেন এবং চারিত্রিক পরিশুদ্ধি ও আদর্শিক মনোবৃত্তি গঠনের মানসে কাজ করে যেতেন। তার দেদার কেরামত বা আলৌকিক ঘটনাবলী প্রদর্শনের কথা মানুষের ঘরে ঘরে কিংবদন্তি হয়ে আছে। ইতিহাস ও এসব ব্যাপারগুলোকে সত্য প্রতিপন্ন করেছে।

 

তার সবচেয়ে বড় আলৌকিকত্ব হলো তার জবান বা মুখ নি:সৃত কথাবার্তা। এসব কথাবার্তা ও পুত:বাণীর মধ্যে এমন আকর্ষণ ছিল যে, শ্রোতাদের মনে তা গভীর দাগ কাটতো। বিনিময়ে অনেক কঠিন হৃদয়ের মানুষ ভ্রান্ত ধর্মালম্বী, ডাকাত সর্দার, পাপী-তাপী লোক ইসলামের অনুশাসনে ঝুকে পড়তো। সে ছোট্টবয়সে তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য মাতৃভক্তি ও সত্যবাদিতার অভাবিতপূর্ণ দৃশ্য দেখে বাগদাদের পথে তাঁর হাতে যে জনৈক দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার নিজ দলবল নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল তা পাঠক মাত্রই অবগত আছেন। তার হাতে যে কত ইহুদী, খ্রিষ্টান মুসলমান হয়েছিল তার হিসাব করা মুশকিল।

 

তিনি প্রায়সময় বলতেন : আমার ইচ্ছা হয় নির্জনে বসে ইবাদতে দিন গুজরান করি, কিন্তু আল্লাহ চান আমার কাছে খিদমতে খালক বা জনসেবা। তাই মানুষের বেষ্টনীর মধ্যেই আমি বসবাস করি। এতে লোকদের সত্যের পথ চিনতে সহজ হয়…।

 

তার বাগদাদ গমনকালের ঐতিহাসিক ঘটনাটি এখানে প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য। ঘর থেকে রওনা দেবার সময় মা মাত্র ৪০টি দিনার বালক আবদুল কাদেরের বগলের নিচে পুরে দেন এবং শেষ নসীহত করলেন : বাপজান, মিথ্যের আশ্রয় নিও না কখনো।’ পথিমধ্যে হামাদান নামক এক মরু অঞ্চলে তাদের কাফেলা মরুদস্যূদের কবলে পড়ে। পুরো কাফেলার সর্বস্ব কেড়ে নেয় দস্যূর দল। এদিকে জীবনের এ প্রথম অভিজ্ঞতার দৃস্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বালক আবদুল কাদের একদিকে দাঁড়িয়ে। শেষমেশ ডাকাত সর্দার এসে হুমকি দিয়ে বললো, পুচকি ছেলে তোমার কাছে কিছু আছে কি? আসলে বালকটিকে দেখতে মনেই হচ্ছিল যে, তার কিছুই থাকার কথা নয়। কিন্তু মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট বালক চট জলদি ঐ দিনার (টাকা) গুলোর কথা বলে দিলেন।
ডাকাত সর্দার হতভম্ব, হতভম্ব হয়ে উঠলো তার দলবল। এ অবুঝ শিশুর মনে-প্রাণে এ কোন আদর্শের স্তুতি………..।

 

অবাক বিস্ময় ঠেকলো তাদের কাছে পুরো বিশ্ব। বালক আবদুল কাদের তাদেরকে মধুর বাণী শোনাতে লাগলেন, মায়ের নসীহত জানালেন। অগত্যা ডাকাত সর্দার সদলবলে জুলুমের পথ পরিহার করে ইসলামের অনুশাসনে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলেন বড় পীরের হাতে।

 

আমাদের সমাজে এ ধরণের উদার ও মুক্ত চিন্তার ধর্ম প্রচারকের আজ বড় অভাব। অথচ নানা ধর্মের নানা আদর্শের গ্লোবালাইজেশনের যুগে হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ) ও অন্যান্য সমমনা আউলিয়া কেরাম কঠোর রিয়াজত সাধনার মাধ্যমে যেভাবে ইসলামকে সাধারণ মানুষের হৃদয়মনে গেঁথে দিয়েছিলেন সে ধারাতেই আজ ইসলামের প্রচার প্রসার হবে সহজতর।

 

লেখক : টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট