চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিদিন ১০ কোটি কাপ চা : আন্দোলন শেষে উৎপাদনের নতুন রেকর্ড 

নাসির ‍উদ্দিন

২১ অক্টোবর, ২০২২ | ৮:১৮ অপরাহ্ণ

চা সুস্বাদু এবং সার্বজনীন পানীয় । সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে এটি পরিবেশন করা যায়। চা পান বাঙালি জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। চা ছাড়া একটি দিনের কথা আজ অনেকেই ভাবতে পারেন না। কিন্তু চায়ের এই অনিবার্যতা অবশ্য খুব বেশি দিনের নয়। সময়ের হিসাবে ২০০ বছরেও পৌঁছায়নি। ঝোপজাতীয় এই উদ্ভিদ সুদূর অতীতকাল থেকে পূর্ব এশিয়ানদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। শুধু এশিয়ান নয়, মাদকতাপূর্ণ স্বাদ এবং একই সঙ্গে অবসাদ দূর করার অলৌকিক ক্ষমতার জন্য চায়ের জয়জয়কার উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—পৃথিবীর সর্বত্র। দেশে চা এসেছে বৃটিশদের হাত ধরে।

 

চিরহরিৎ এই উদ্ভিদের শুকনা পাতা থেকে চা-পানীয় প্রস্তুত করার কলাকৌশল চীনারাই প্রথম আয়ত্ত করেছিল। চীনা ‘টেই’ শব্দ থেকে ‘চা’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে মনে করে অনেকে । চীনা সংস্কৃতির সঙ্গে চা-সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে সূদুর অতীতকাল থেকে। পৃথিবীব্যাপী কড়া পানীয় হিসেবে চায়ের কদর অনেক দিন ধরেই বজায় আছে। ১৫০০ সালের দিকে চীনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আধা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিস্বরূপ এটি প্রথমে জাপানে প্রবর্তিত হয়েছিল। এর বেশ কিছুকাল পরে আনুমানিক ১৬০০ সালের দিকে ওলন্দাজ বণিকদের মাধ্যমে সারা ইউরোপে চায়ের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৬০ সাল নাগাদ এটিকে ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে পরিচিত করায় এবং সেই থেকে সমগ্র ইউরোপে পানীয় হিসেবে চায়ের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর এর যাত্রা বিস্তৃত হয় সমগ্র আফ্রিকায়। চা আজ পৃথিবীর এক নাম্বার পানীয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এই বাগানটি প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলতঃ মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো। একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালি’ নামে পরিচিত । আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত । বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে লস্করপুর ভ্যালি, বালিশিরা ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি নামে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে এবং হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (বিটিআইএমসসি) গঠন করে মালিকানাবিহীন, পরিত্যাক্ত চা বাগানগুলোকে মালিকদের নিকট পুনরায় হস্তান্তর করা হয়। এই শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় তৎকালীন সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। উক্ত সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তখন থেকে চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (BTRI) নামে পরিচিত। চা বোর্ড এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে শিক্ষা, কন্যা বিবাহ, চিকিৎসা অনুদান দেয়া হয়। শ্রমিক ইউনিয়নের সুপারিশের মাধ্যমে অনুদান অনুমোদন করে কমিটি । বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও বৃত্তি প্রদান করা হয়।

 

২০২১ সালে ৩১৮জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা অনুদান এবং ৬১জন শ্রমিকের কন্যা বিয়ে অনুদান দেয়া হয়। বাগানগুলোতে বাসস্থান, চিকিৎসা, বাচ্চাদের দেখার জন্য রয়েছে মাদার ক্লাব। চা বোর্ড এর তথ্যমতে, মজুরীর বাইরে প্রতি সপ্তাহে ২ টাকা কেজি ধরে সাড়ে ১০কেজি চাল বা আটা পান শ্রমিকরা। ঘরসহ থাকা ফ্রি, চাষাবাদ ফ্রি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী লালন-পালনের সুবিধা। ৩৬৫ দিনে ১০০দিন কাজ না করলেও হাজিরা। ৫২দিন সাপ্তাহিক ছুটি।১৪দিন উৎসব ছুটি। ১৪দিন অর্জিত ছুটি। ২০দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি। ১৫ শতাংশ ভবিষ্যৎ তহবিল। কাজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪ টা ৮ ঘন্টা । নিয়ম মোতাবেক ২৩ কেজি কাঁচা পাতা তোলায় দৈনিক এক হাজিরা। বাড়তি প্রতিকেজিতে ৫ থেকে ৬টাকা আয়। দুই বছর পরপর শ্রম মন্ত্রণালয়ের ডিজি’র নেতৃত্বে বিটিএ ও চা বাগান মালিকরা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে বৈঠক করে শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারণ করে থাকেন। শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরীর সীমা শেষ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। ২০২১ এর জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। দেরি হওয়ার কারণে শ্রমিকরা আন্দোলেনে নামেন। শ্রমিকদের আন্দোলনে গেল আগস্টে ১৯দিন চায়ের পাতা তোলা বন্ধ থাকে। পরে সরকার তাদের দৈনিক মজুরী ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করার পর শ্রমিকরা কাজে ফিরে।

 

চা বাগান মলিকদের সংগঠন বিটিএ চেয়ারম্যান শাহ আলম আন্দোনের কারণে প্রতিদিনের ক্ষতি ২০ কোটি টাকা বলে দাবি করেন। আশার কথা-মজুরি নিয়ে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের পর সেপ্টেম্বরে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। এ সময়ে দেশের ১৬৭টি বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানে চা উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ কেজি। এর আগে মাসভিত্তিক সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল গত বছরের অক্টোবরে। ওই মাসে ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। চা উৎপাদনের এ তথ্য গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বললেন, গত সেপ্টেম্বরে রেকর্ড উৎপাদন চা-শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা। প্রয়োজনীয় বৃষ্টি, সঠিক সময়ে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ, চা রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা, নিয়মিত বাগান তদারকি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করায় এ বছর চায়ের উৎপাদন ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাগানমালিক, চা ব্যবসায়ী ও চা-শ্রমিকদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে চা-শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে জানান তিনি।

 

১৯৭০ সালে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬.০৭ কেজি এবং ২০২০ সালে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ২০২০ সালে ২.১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়। ২০২১ সালে উৎপাদন হয় ৯৬.৫ মিলিয়ন কেজি চা । চা বোর্ড এ বছর ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে চা উৎপাদিত হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে আগামী ৩ মাসে ৩ কোটি ৬২ লাখ কেজি চা উৎপাদন করতে হবে । আগস্টে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে চা-বাগান মালিকদের। শ্রমিকরা ভাল থাকলে, বাগানের মালিকরা ভাল থাকবেন। মালিকরা লাভবান হলে এই শিল্প এগিয়ে যাবে। হারানো গৌরব আমরা আবারও ফিরে পাব। ভাল দিক হলো আমরা চায়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ। শুধু তাই নয়, আমরা অল্প স্বল্প রপ্তানিও করছি। আরো বেশি করা যেত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চা শিল্পেও পড়েছে। কম বৃষ্টিতে তৈরি খরা মোকাবেলায় আর্টিফিশিয়াল ইরিগেশন সিষ্টেম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ফলে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব কাটানো সম্ভব হবে। । বর্তমানে চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র রয়েছে দু’টি ।

 

চা উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশি চায়ের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা । জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। ২০২৫ সালে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনে সক্ষম হওয়ার আশা করছে চা বোর্ড । সেক্ষেত্রে ১০-১৫ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। রপ্তানি তখনই সম্ভব হবে যখন চা এর কোয়ালিটি ভাল হবে। তখন বৈশ্বিক বাজারে আমরা টিকে থাকতে পারবো। তবে চা বোর্ডের লক্ষ্য দেশীয় যে চাহিদা সেটা মেটাতে হবে, তারপর রপ্তানি। ১৯৭৫ সালে ৩০মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হতো। তখন দুই-তৃতীয়াংশ রপ্তানি হতো। চা এখন সবাই খায়। প্রতিদিন প্রায় ১০কোটি কাপ চা পান করছি আমরা । এখন আমরা নিজেরাই শতভাগ পান করছি। রপ্তানি করবো কি?

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/রাজীব/পারভেজ/

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট