চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্তন ক্যানসারের খরচাপাতি ও আমাদের করণীয়

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

৯ অক্টোবর, ২০২২ | ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

গ্লোবাল ক্যানসার অবসারভেটরি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এদের প্রধান কাজ হল পৃথিবীর সমস্ত দেশের ক্যানসার ডাটা সংগ্রহ করে প্রকাশ করা। সাধারণত এই সংস্থা প্রতিটি দেশের ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে তথ্য পেয়ে থাকে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি চালু হয়নি। যার ফলে আমাদের দেশের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সঠিক তথ্যপাওয়া কস্টসাধ্য। আমাদের প্রতিবেশী দেশের তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের দেশের ক্যানসার রোগীর সংখ্যার একটি ধারণা পাওয়া যায়। এই ধারণা অনুযায়ী গ্লোবোকন এর হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক ১৩ থেকে ১৫ হাজার মহিলা স্তন ক্যানসার এ আক্রান্ত হন। ভুক্তভোগী সকলেই জানেন স্তন ক্যানসার এর চিকিৎসা খুবই ব্যায়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। চট্টগ্রামে স্তন ক্যানসারের সম্পূর্ণ চিকিৎসা অপ্রতুল। দেশে স্তন ক্যানসার এর চিকিৎসা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা বাবদ খরচ হতে পারে কমপক্ষে ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা অথবা তারও বেশী। অনেকেই ভারত, থাইল্যান্ড অথবা সিংগাপুরে চিকিৎসার জন্য যান। যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তার উপর ভিসাজনিত জটিলতা তো আছেই। দেশের বাইরে খরচ হতে পারে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার ও বেশী।

কেন এত টাকার দরকার?
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা একজন ডাক্তারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ক্যানসার সনাক্ত থেকে শুরু করে চিকিৎসা শেষ করতে কমপক্ষে ৫-৬ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কনসালটেন্সি নিতেহয়। এই ডাক্তারদের গ্রুপে থাকেন ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান, রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, ব্রেস্ট সার্জন, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট। ডাক্তার ছাড়াও অন্যান্য সহযোগী প্যারামেডিকস যেমন অনকোলজি নার্স, মেডিক্যালফিজিসিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট এবং সাইকোলজিস্ট এর সাপোর্ট দরকার হয়। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃরিত প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল ইকুইপম্যান্টস অনেক ব্যয়বহুল। এই যন্ত্রপাতিগুলোর ভেতর উল্ল্যেখযোগ্য হলো ম্যামোগেরাম মেশিন, যেটা দিয়ে রোগনির্নয় করা হয়। এই মেশিনের দাম কোটি টাকার উপর এবং একবার ম্যামোগেরাম এর খরচ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকা। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি অপরিহার্য। রেডিয়েশন থেরাপি মেশিনের নাম লিনিয়ার একসেলেরেটর। এই মেশিনের দাম ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। স্তনে রেডিয়েশনের সাহায্যে চিকিৎসা করালে রেডিয়েশন বাবদ খরচ হতে পারে ১ লাখ টাকা থেকে ২ লাখটাকা। স্তন ক্যানসারের অপারেশন সব সার্জন করতে পারদর্শী নয়। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সার্জনরাই স্তন ক্যানসারের সার্জারি করতে পারেন। উনারা ব্রেস্ট সার্জন হিসাবে পরিচিত। সার্জারি বাবদ খরচ হতে পারে ১ থেকে ৩ লাখ টাকা।

 

এছাড়াও প্যাথলজি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, বোন স্ক্যান এবং অন্যান্য ইনভেস্টিগেশনের খরচ তো আছেই। সবচেয়ে বেশী খরচ হয় দীর্ঘমেয়াদী কেমোথেরাপির ওষুধ বাবদ। একটি উদাহরণ দিলে আপনারা বুঝতে পারবেন কেমোথেরাপির ওষুধের দাম কেমন। যেমন হারছেপটিন ইনজেকশনের একটি ভায়ালের দাম ১লাখ টাকার কাছাকাছি। প্রতি ৫ জনের মধ্য ১জন স্তন ক্যানসারের রোগীর এই ইনজেকশন প্রয়োজন হয়। প্রতি ৩ সপ্তাহ পর পর কমপক্ষে ৬- ১২ মাস এইইনজেকশন রোগীরা পেয়ে থাকেন। মোট কথা স্তন ক্যানসার বাংলাদেশের একটি পরিবারের জন্য বিশাল একটা অর্থনৈতিক ধসের কারণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হতে পারে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাকে জাতীয়করণ করা। এটা করতে হলে আমাদেরকে একটি সমন্বিত স্তন ক্যানসার পরিষেবা চালু করতে হবে। প্রথম ধাপে ৮টি বিভাগীয় হাসপাতালে ডেডিকেটেড আন্তর্জাতিক মানের ওয়ান স্টপ স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা চালু করাটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সকলের সহযোগিতা ছাড়া স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যক্তিগতভাবে করা খুবই ব্যায়বহুল। সরকারের ডিসিশন মেইকিং বডিতে যারা আছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখনই সময় এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া।
ক্যানসার ধনী, গরীব, শিক্ষিত , অশিক্ষিত, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কাউকেই তোয়াক্কা করে না। সুতরাং ক্যানসার প্রতিরোধে এবং চিকিৎসায় আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।

লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, কানাডা। ইমেইল : [email protected]

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট