চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মুহাম্মদ (সা.) এর অভিভাবক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ

৫ অক্টোবর, ২০২২ | ১:৫৩ অপরাহ্ণ

পৌত্তলিকতার অন্ধকারে যখন বিশ্ব ডুবে গিয়েছিল, তখন আল্লাহপাক মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বজগতের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এরপর বিশ্ববাসীকে মুক্তি ও শান্তির পথে আহ্বান জানান। সব ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্যায়, অবিচার ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মানবসত্তার চিরমুক্তির বার্তা বহন করে এনেছিলেন তিনি। এরপর মহানবী (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর এ বার্তা প্রচার করে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

আল্লাহপাক রাসুল (সা.) সম্পর্কে বলেছেন,‘আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি বিশ্ব জগতের জন্য বিশেষ রহমত স্বরুপ।’
অতি অল্প বয়স থেকেই আল্লাহ তাকে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেন। জন্মের পূর্বে পিতা, ৬ বছর বয়সে মা আমিনাকে হারান। এবং ৮ বছর বয়সে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াতীম শিশু বড় হয়ে উঠেন চাচা আবু তালিবের সযত্ন ভালবাসায়।

মুহাম্মদ (সা.) জন্ম হওয়ার সংবাদ শুনে দাদা আব্দুল মুত্তালিব ছুটে আসেন। পরম স্নেহে দেখেন, যত্নের সঙ্গে কোলে নিয়ে কা’বার ভেতর প্রবেশ করেন,আল্লাহর হামদ বর্ণনা করেন এবং দোয়া করেন। অতঃপর তাঁর নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’। বিবি আমিনা গর্ভাবস্থায় স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নাম অনুসারে ‘আহমদ’ নাম রাখেন।
বাল্যকাল হতে মুহাম্মদ ও আহমদ উভয় নাম প্রচলিত ছিল যা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।

সর্ব প্রথম তাঁকে মা হযরত আমেনা দুগ্ধ পান করান। অতঃপর তৎকালীন মক্কার প্রথানুযায়ী শিশুসন্তানদের জন্মের পর মরুভূমির মুক্তাঞ্চলে লালন পালনের ব্যবস্থা করার জন্য ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন। এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন হালিমা আস সাদিয়া । অন্য কোন ধাত্রী শিশু মুহাম্মদকে গ্রহণ করলনা পক্ষান্তরে হালীমা সাদীয়াও অন্য কোন শিশু পেলনা। ফলে বাধ্য হয়ে রাসূল (সা.) কে গ্রহণ করলেন।

ইয়াতিম শিশু মুহাম্মদ, এই ভয়ে কেউ গ্রহণ করেননি। কিন্তু কেউ জানেন না আল্লাহপাক এই ইয়াতিম সন্তানের জন্য আসমান-জমিন বানিয়েছেন। এই ইয়াতিম সন্তানকে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। তাঁকে আল্লাহ হাবিব বানান। তাঁর দুনিয়াতে অভিভাবক বাবা ছিলেন না । তাঁর অভিভাবক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ।

হালিমা আস সাদিয়া ছিলেন মুহাম্মদ (সা.) এর দুধমা। ৮দিন বয়সে তিনি মুহাম্মদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন,এবং দুই বছরের কিছু অধিক সময় পর্যন্ত তাকে মদীনায় নিজ বাড়িতে লালন-পালন করে, তার মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। হালিমা বর্ণনা করেন,“সে বছর ছিল অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষের বছর। আমি বনু সাদ গোত্রের আরো দশজন মহিলার সাথে একটি দুর্বল উটনীর উপর সওয়ার হয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে বের হলাম। আল্লাহর কসম! তার ওলান থেকে একটু দুধও বের হচ্ছিল না। ক্ষুধার জ্বালায় আমাদের শিশুদের কান্নাকাটির কারণে আমরা রাতে মোটেও ঘুমোতে পারতাম না। আমার বুকের ও আমাদের উটনীর দুধে আমার শিশু পুত্র আবদুল্লাহর পেট ভরতো না। তবে আমরা বৃষ্টি ও সচ্ছলতার আশা করতাম।

অবশেষে আমরা মক্কায় পৌঁছলাম। আমাদের প্রত্যেকের সামনে শিশু মুহাম্মাদকে উপস্থাপন করা হলো। তিনি ইয়াতীম শিশু একথা শোনার পর কেউ আর তাঁকে নিতে আগ্রহ দেখালো না। কারণ আমরা শিশুর পিতা-মাতার নিকট থেকে ভালো কিছু লাভের আশা করতাম। আমরা বলাবলি করতাম:শিশুটি ইয়াতীম। তার মা ও দাদা তেমন কী আর দিতে পারবে? এ কারণে আমরা তাকে অপছন্দ করলাম। এই দলের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া আর সবাই লালন-পালনের জন্য শিশু পেয়ে গেল। যখন আমরা আমাদের গোত্রে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমি আমার স্বামীকে বললাম:আল্লাহর কসম! অন্যরা এতিম লালন-পালনের জন্য শিশু নিয়ে ফিরবে আর আমি শূন্য হাতে ফিরবো,এটা আমার পছন্দ নয়। আমি এই হাশিমী ইয়াতীম শিশুটির নিকট যাব এবং তাকেই নিয়ে ফিরবো। আমার স্বামী বলল, ঠিক তুমি তাই কর,হতে পারে এর মধ্যেই আমাদের বরকত রয়েছে। অতপর তিনি মুহাম্মাদ (সঃ) কে গ্রহণ করলেন এবং তাকে নিয়ে সেখান থেকে রওয়ানা হলেন”।

বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদকে (সা.) গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করলেন যে, তার স্তন দুটি দুধে পরিপূর্ণ। তা থেকে শিশু মুহাম্মদকে দুধ পান করালেন। তার সন্তান আব্দুল্লাহকেও দুধ পান করালেন। যে বয়স্ক ও দুর্বল সাওয়ারিতে করে তারা মক্কায় এসেছেন, সে সাওয়ারী অন্যদের সাওয়ারী থেকে শক্তিশালী ও তার পালনেও দুধে ভরপুর হয়ে গেল। তা থেকে হজরত হালিমার স্বামী হারিস দুধ দোহন করে তারা উভয়ে তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করলেন।

হজরত হালিমার স্বামী তখন স্ত্রীকে বললেন, হে হালিমা! জেনে রেখো, তুমি এক মহান কল্যাণময় শিশু পেয়েছ। হজরত হালিমা বলেন, ‘আমারও তা-ই মনে হয়।’ শুরু হলো শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে হালিমার পথচলা। মক্কায় আসার পথে যে বাহনে আসতে বিবি হালিমার কষ্ট হয়েছিল এবং তারা কাফেলা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। সে সাওয়ারী শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে গোটা কাফেলাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো।

কাফেলার সহযাত্রী নারীরা বলতে লাগলো, হে আবু যুয়াইবের কন্যা! একটু দাঁড়াও এবং আমাদের জন্য অপেক্ষা কর। এটা কি সেই সাওয়ারী নয়, যেটায় চড়ে তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছিলে? হজরত হালিমা সাদিয়া বললেন,‘হ্যাঁ’। তারা বলল,‘আল্লাহর কসম! এ সাওয়ারী আগের অবস্থার পুরোপুরি উল্টো।’

মুহাম্মাদ (সা.) তার দুধ মাতা হালিমাকে সবসময় সম্মান করতেন। একবার নিজের চাদরে তাকে বসতে দিয়েছিলেন। তাকে বিভিন্ন অভাবের সময় উপঢৌকন পাঠিয়েছেন। একবার খাদিজা(রা.)তাকে ৪০টা ছাগল ও একটি উট দান করেছিলেন। এই হালিমা সাদিয়ার ঘরে অবস্থান কালেই মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রথম বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটে।

পঁচিশ বছর বয়সে মক্কার ধনবতী মহিলা খাদিজা বিনতে খোয়ালিদের সাথে রাসূল(সা.) এর বিয়ে হয়। মুহাম্মদ (সা.) এর সততা, সত্যবাদীতা ও বিশ্বস্ততা তখন সুবিদিত ছিল। তাঁর প্রশংসা শুনে তিনি তার কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। মুহাম্মদ (সা.) রাজী হন এবং ব্যবসা শেষে অনেক বেশি লাভসহ তার সব কিছু বুঝিয়ে দেন। উভয়ের সম্মতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন রাসূল (সা.) আর কোনো বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এরপর আদর্শিক প্রয়োজনে এবং নারী সমাজের বিভিন্ন উপকারের জন্য তিনি মোট ১১টি বিয়ে করেন। দু’জন তার মৃত্যুর পূর্বে মারা যান। আর ৯ জনের সাথে তিনি বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করেন।

৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। জিবরাইল (আ.) তাঁর সামনে হেরা গুহায় এলেন এবং বললেন: পড়ুন। তিনি উত্তর দিলেন আমি কিভাবে পড়ব? ফেরেশতা বললেন:“পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে, তোমার পালনকর্তা মহান দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না”। (সূরা আলাক: ১-৫)

৫১ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে সশরীরে ইসরা ও মি’রাজ ভ্রমণের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) একরাতে সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহর আরশে আজীমে পোঁছান। মি’রাজ সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান লাভ করেন। তিনি জান্নাত এবং জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।

তিনি সর্বপ্রথম পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বর্গকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম খাদীজা রা. তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবূ বকর সিদ্দীক (রা.), ছোটদের মধ্যে আলী ইবনে আবূ তালিব রা. এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন।

মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে মদীনার হিজরত করে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মদীনা শরীফে এ মসজিদটি“মসজিদে কু’বা” নামে পরিচিত। মদীনাতে রাসুল (সা.) মসজিদে নববী নির্মাণ শেষে আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন।

দশম হিজরীতে রাসুল (সা.) ১ লাখ লোক নিয়ে মক্কায় হজব্রত পালন করেন। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এবং আল্লাহপাকের এই বাণী তিলাওয়াত করেন- “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রা.) এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। অবশেষে ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল সন্ধ্যায় তিনি মহান প্রতিপালকের সান্নিধ্যে চলে যান।

লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/আর/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট