‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ আজকের যারা শিশু আগামী দিনে তারাই হবে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ার নেপথ্য কারিগর, তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে মধ্যম আয়ের দেশে, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, সগৌরবে উড়বে লাল সবুজের পতাকা।
তবে এই জাতি গড়ার অগ্রণী নায়কদের গড়ে তুলতে হবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সুদক্ষ করে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেশ, জাতি, সরকার, সমাজ এবং সর্বোপরি সকল স্টেইক হোল্ডারদের।
শিক্ষা এবং কেবলমাত্র আধুনিক , গুনগত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষাই পারে একবিংশ শতাব্দীর চ্যলেঞ্জ মোকাবেলায় সুদক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে। এজন্য প্রয়োজন গতানুগতিক শিক্ষাদান পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আধুনিক, বাস্তবসম্মত ও সর্বজন স্বীকৃত ও সর্বাধিক কার্যকর Experiential Learning (অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা) পদ্ধতির দিকে জোর দেওয়া। তবেই, শিক্ষিত বেকার যুবক তৈরি হবে না বরং গড়ে উঠবে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে। আর শিক্ষার মূলস্তম্ভ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। তাই, আমাদের মূল ফোকাস দিত হবে এখানেই। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষণা অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাইমারি শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করছে, তাদের যখন কর্মক্ষেত্রে ঢোকার বয়স হবে, সে সময়কার কাজ বা বৃত্তি অথবা পেশা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের হবে, যার সম্বন্ধে এখন আমাদের কোন ধারণাই নেই। তার মানে হলো, এই শিক্ষার্থীদের যদি সেসব কাজের জন্য আমরা তৈরি করতে না পারি, অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত করতা না পারি তাহলে জনগোষ্ঠীর এই তারুণ্য বিফলে যাবে।
হার্বাট স্পেন্সার এর বিখ্যাত উক্তি- “শিক্ষার কাজ হল মানুষকে জীবন ও জীবিকার উপযোগী করে তোলা।’
আমেরিকান শিক্ষাবিদ এডগার ডেল তাঁর তার একটি বই Can You Give The Public What It Wants (1967) এ অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার বর্নণা দিতে গিয়ে বলেন, শিখন হচ্ছে চারটি জৈব প্রক্রিয়ার সমষ্টি যেমন
১। চাহিদা/ প্রয়োজন , ২। অভিজ্ঞতা, ৩। অভিজ্ঞতার একীভূতকরণ এবং ৪। সেই অভিজ্ঞতার ব্যবহার। ডেল আরো বলেন, কার্যকর শেখার পরিবেশ সমৃদ্ধ এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হওয়া উচিত যেখানে শিক্ষার্থীরা দেখতে, শুনতে, স্বাদ নিতে, স্পর্শ করতে এবং চেষ্টা করতে পারে। ডেল (1969) সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে এভাবে প্রকাশ করেছেন- ১। শিক্ষার্থীরা এতে ডুবে থাকে এবং অভিজ্ঞতা অন্বেষণ করতে তাদের চোখ, কান, নাক, মুখ এবং হাত ব্যবহার করে ২। শিক্ষার্থীদের নতুন অভিজ্ঞতা এবং তাদের সম্পর্কে নতুন সচেতনতা আবিষ্কার করার সুযোগ রয়েছে ৩। ছাত্রদের মানসিকভাবে ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা রয়েছে যা তাদের সারা জীবন শেখার জন্য অনুপ্রাণিত করবে ৪। শিক্ষার্থীদের তাদের অতীত অভিজ্ঞতা অনুশীলন করার এবং নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করতে তাদের একত্রিত করার সুযোগ রয়েছে৫। ছাত্রদের ব্যক্তিগত অর্জনের অনুভূতি আছে ৬। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব গতিশীল অভিজ্ঞতা বিকাশ করতে পারে ডেলের মতে (১৯৭২), স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা কীভাবে চিন্তা করতে, আবিষ্কার করতে এবং বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে হয় তা শিখতে পারে না বা শিখে না, আরো পরিস্কারভাবে বললে সেই পরিবেশ নেই। বরং, অধিকাংশ স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের যে কোন তথ্য ও জ্ঞান মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয় , ফলস্বরূপ, তারা যে জ্ঞান অর্জন করে তা তাদের বাস্তব জীবনে কোন কাজে আসে না । একসময়, শিক্ষিত বেকারে পরিণত হয়, পরিবারের জন্য হয় বোঝাস্বরুপ, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাধা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ” শিশু বয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নাই; তাহা মনকে যতটা দেয় তাহার চেয়ে পিষিয়া বাহির করে অনেক বেশি।’
ডেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, শিক্ষাগত শিক্ষার পরিবেশের মান উন্নত করার জন্য আমাদের বৈপ্লবিক পন্থা অবলম্বন করা উচিত। যেখানে, আমার শিশুরা মনের আনন্দে, জড়তাবিহীন পরিবেশে নিজেদের চাহিদা, অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার একীভূতকরণ এবং বাস্তব জীবনে তা ব্যবহারের লক্ষ্যে শিখবে। মুখস্থ বিদ্যা পরিহার হবে, নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে এগিয়ে যাবে শিখন প্রক্রিয়া। তাই ডেল, সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত শেখার পরিবেশ তৈরি করতে, নতুন উপকরণ এবং নির্দেশনার পদ্ধতির বিকাশের জন্য যুক্তি দিয়েছিলেন। ডেল অডিওভিজ্যুয়াল উপকরণগুলির সম্ভাবনাকে প্রচার করেছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন যে তারা প্রাণবন্ত এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করতে পারে এবং সময় এবং স্থানের সীমাবদ্ধতা নির্বিশেষে তাদের প্রসারিত করতে পারে। যার মাধ্যমে, সমস্ত বিশ্বকে হাজির করতে পারি শ্রেণিকক্ষে, অতীত কে নিয়ে আসতে পারি বর্তমানে, বিমূর্ত ধারণা করতে পারি মূর্ত , প্রাণহীন নিরশ পাঠকে করতে পারি অংশগ্রহনমূলক সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের করতে পারি বিদ্যালয়মুখী। তাই, অভিজ্ঞতামূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুমের বিকল্প কোন মাধ্যম নাই। যদিও, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের দিক দিয়ে আমরা বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি। তবুও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আমরা পাড়ি দিয়েছি অনেকটা দুর্গম পথ। প্রথমে প্রতি উপজেলায় দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম স্থাপনের মাধ্যমে এই অগ্রযাত্রা শুরু হলেও এখন প্রতিটি উপজেলার প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই রয়েছে এই ব্যবস্থা, রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শ্রেণিকক্ষ। প্রতিটি পিটিআই এ রয়েছে ৩০টি কম্পিউটার ও সার্বক্ষণিক ওয়াইফাই সমৃদ্ধ সুবিশাল ল্যাব। যেখানে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১২দিন ব্যপী আইসিটি-ইন-এডুকেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম পরিচালনায় দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। স্কুলগুলোতে, পর্যায়ক্রমে দেওয়া হচ্ছে ব্রডব্যান্ড এবং ক্ষেত্র বিশেষে জিপি মডেম সমৃদ্ধ ইন্টারনেট সংযোগ। যদিও বা, এখনো পর্যন্ত সকল বিদ্যালয়ে কাঙ্খিত মানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি, তবুও, থেমে নেই আমাদের তথ্য প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা। সারা বাংলাদেশের ৫০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ‘ ডিজিটাল ইন্টারএক্টিভ হোয়াইট বোর্ড’ । নতুন শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে ‘শিশুদের উপযোগী কোডিং’ । তাই, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং অভিজ্ঞতামূলক শিখনকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন আরো আইসিটি জ্ঞান সমৃদ্ধ শিক্ষক তৈরি করা, ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করা, প্রয়োজনে, বিদ্যালয় পর্যায়ে আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা। এর প্রয়োজনীয়তা কে উপলব্ধি করে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে বশ কিছু অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম যেমন ‘টেন মিনিট স্কুল’, ‘রেপ্টো’, ‘শিক্ষক বাতায়ন’, ‘ই-শিক্ষণ’, ‘স্টাডি-প্রেস’ । যাদের মূল থিম হচ্ছে, বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করে বাস্তবসম্মত ও আধুনিক শিক্ষাদান করা। সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই অগ্রযাত্রায়, নিশ্চিত করতে হবে উচ্চ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিখন পরিবেশ, দূর করতে হবে আইসিটি ফোবিয়া, প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করতে হবে Experiential Learning (অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা) পদ্ধতি, তবেই আমরা পাব সমৃদ্ধ জাতি। জয় হউক প্রাথমিক শিক্ষার, জয় হউক আইসিটির……
লেখক : মোহাম্মদ আবদুল বাতেন, ইন্সট্রাক্টর (কম্পিউটার সায়েন্স), পিটিআই, চট্টগ্রাম ।
পূর্বকোণ/মামুন/পারভেজ