চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শুচিস্নাত হই জন্মাষ্টমীর পবিত্র পরশে

চন্দন মণ্ডল

১৯ আগস্ট, ২০২২ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আজ থেকে ৫ হাজার ২৪৮ বছর পূর্বে দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রে ভোজবংশীয় রাজা উগ্র সেনের পুত্র কংসের কারাগারে দেবকীর কোলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অষ্টমী তিথিতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে এই জন্মতিথির নাম জন্মাষ্টমী তিথি। হিন্দু ধর্মানুসারে তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবতিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী পালন করা হয়।

শ্রীমদ্ভগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়গুণ যথা-ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন ‘পূর্ণাবতাররূপে’ প্রকাশিত হন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ আরো বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।

দ্বাপর যুগের কয়েক জন রাজা খুব অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মগধের রাজা জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপাল, মথুরার রাজা কংসসহ অনেকে। তাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের মামা মথুরার রাজা কংসের কথাই ধরা যাক। কংস নিজের পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে বন্দি করে অধিকার করেন মথুরার রাজসিংহাসন। প্রজাদের ওপরও চালান উৎপীড়ন। কংসের কাকা দেবক। তার কন্যা দেবকী। সুতরাং দেবকী সম্পর্কে কংসের কাকাতো বোন। তবে কাকাতো বোন হলেও কংস তাকে সহোদরার মতোই স্নেহ করতেন। শূরবংশীয় বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে হয়।

বসুদেবের সঙ্গে দেবকী যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাবেন, তখন কংস নিজেই রথ চালিয়ে তাদের পৌঁছে দিতে যান। কিন্তু পথে দৈববাণী শুনতে পান কংস। সে দৈববাণীর মর্ম হলো, দেবকীর গর্ভজাত অষ্টম পুত্রসন্তান কংসকে হত্যা করবে। ভাগনের হাতে মৃত্যু! এ ভবিতব্য সংঘটিত হতে দেওয়া যায় না। তখন কংস তরবারি কোষমুক্ত করে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। বসুদেব দেবকীকে রক্ষা করার জন্য কংসকে বলেন যে, সন্তানের কারণেই তো ভয়! তাদের সন্তান হওয়ামাত্র তারা সে সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেবেন। যুক্তিটি কংসের কাছে মন্দ লাগে না। তিনি দেবকীকে হত্যা না করলেও প্রথমে গৃহবন্দি করে রাখেন, পরে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কারাগারে এদের পরপর ছয়টি সন্তান হয়, তাদের সবাইকে কংস নির্মমভাবে হত্যা করেন। অত্যাচারী কংসের কারাগারে বন্দি বসুদেব ও দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরাম আসেন; কিন্তু কংসের হাত থেকে সেই শিশুকে বাঁচানোর জন্য শ্রীহরি বিষ্ণুর আদেশে দেবী যোগমায়া দেবকীর সপ্তম গর্ভের ভ্রূণ সেখান থেকে নন্দগৃহে রোহিণীর গর্ভে স্থাপিত করেন। ফলে দেবকীর সপ্তম গর্ভ মৃত সন্তান জন্ম দেয় এবং রোহিণীর গর্ভে বলরামের জন্ম হয়।

উপস্থিত হয় কাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি। মধ্যরাত্রির নিবিড় অন্ধকারে ভুবন আবৃত। সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এরকম সময়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, চতুভুর্জ মূর্তিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে আবির্ভূত হন। বসুদেব দেবকী বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে প্রত্যক্ষ করেন শ্রীভগবানের সেই জ্যোতির্ময় আবির্ভাব। আবির্ভূত দেবকী-বসুদেব নয়নভরে দেখেন অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোহর শিশুটিকে চতুভুর্জ, বর্ণমালা পরিহিত অবস্থায়। বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন, সারা অঙ্গে মণিমুক্তাখচিত বহু মূল্যবান অলংকারাদি। ভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবলীলা সত্যিই অপূর্ব সুশোভামণ্ডিত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, শ্রীকৃষ্ণকে যখন বসুদেব যশোদার গৃহে নিয়ে যান তখন ছিল ঝড়বৃষ্টি। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে অনন্তদেব এসে ফণা বিস্তার করে চক্রধারণ করেন। ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণগমনের পথ সুগম করে দেন। এসবই শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ।

ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি- এক কথায় সর্ববিধ জীবনাচরণের ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি অর্জুনের মাধ্যমে গীতার ১৮টি অধ্যায়ে জাগতিক জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম, বিভূতি, ভক্তি, মুক্তি, মোহ, যশ, খ্যাতি আর অর্থবিত্তের মায়াজাল, অন্যায়, অসত্য, পাপ আত্মাহংকার, মোক্ষলাভ প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। পৃথিবীর সব কলুষিত পরিবেশ ও কলুষিত বন্ধন দূর করে এ পৃথিবীর সব জীবের মধ্যে আত্মার বন্ধন সুদৃঢ় করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একরূপে চক্রধারী কঠোর, আরেক রূপে তিনি কুসুম কোমল, দীনবন্ধু-করুণা সিন্ধু। তাই আসুন, আমরা এই দিনটির অমর বার্তায় অভিস্নাত হয়ে নিজেদের জীবনকে উজ্জীবিত করে সবাই শুচিস্নাত হই জন্মাষ্টমীর পবিত্র পরশে।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট