পবিত্র মহরমের দ্বিতীয় দশক আমরা অতিক্রম করছি। ইতোমধ্যে বিশ্বের সকল হাজীরা পবিত্র মক্কা মদীনায় হজ্ব ও জেয়ারত শেষে স্বদেশে ফিরে গেছেন। আমরাও আমাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করেছি। আল্লাহ পাকের শোকর তিনি দুই বছর পর অত্যন্ত সুন্দর শোকর এবং সবরের মাধ্যমে আমাদের পবিত্র হজ্ব নসীব করেছেন। এ বছর হজের অনুষ্ঠানমালা অন্যান্য বছরের তুলনায় সুবিন্যাস্ত ছিল। কারণ অন্যান্য বছর যেখানে ৩০ – ৩৫ লাখ মুসল্লির সমাবেশ ঘটত পবিত্র হারামে সেখানে এ বছর মাত্র ১০ লাখ। তবুও হাজরে আসওয়াদ, মুলতাজিম, হাতীম, রোকনে ইয়েমেনির বরকত বা স্পর্শকরণ ছিল হাজীদের জন্য নিষিদ্ধ, অধরা। দেরীতে হলেও সুখের খবর হলো আড়াই বছর করোনাকালীন আল্লাহ তায়ালার কালো ঘর দর্শনার্থীদের জন্য অধরা থাকলেও এ বছরের হাজী সাহেবানের দেশে প্রত্যাবর্তনের পরপর উমরাহযাত্রীদের জন্য কাবা শরীফের ব্যারিকেড উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সে যাই হোক বরকত ও বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাস জিলহজ্ব আমরা অতিক্রম করেছি পবিত্র হজ্ব ও কুরবানীর আনন্দধারা নিয়ে।
জিলহজ্ব শাব্দিক অর্থেই হজ্বের স্মৃতিবাহী মাস। এ মাসের নয়া চাঁদ উদিত হতেই মুসলমানদের হৃদয় মন হজ্ব ও ঈদুল আজহার স্মরণে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, হে নবী (স.) তারা আপনার কাছে নয়া চাঁদ সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি বলুন কুল হিয়া মাওয়াকিতুল লিননাস ওয়াল হাজ্ব- তা হলো মানবজাতির জন্য একটি ক্যালেন্ডার স্বরূপ, আর হজ্বের।’ এ আয়াতে মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা নয়া চাঁদ উদিতকরনের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে সারাবছরে বারো চাঁদের গুরুত্ব এবং বিশেষত হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে জিলহজ্ব মাসের গুরুত্ব প্রকাশ করেছেন। জিলহজ্ব মাসের ৭ম তারিখ দিনগত রাতে হাজী সাহেবান মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র হজ্বের নিয়তে মিনায় গমনের মাধ্যমে হজ্বব্রত পালনের সূত্রপাত করেন। ৯ জিলহজ্ব তারা পবিত্র আরাফাতের ময়দানে উকফ করেন বা হজ্বের প্রধান আহকাম হিসেবে অবস্থান করেন। এ দিন দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করার পর ১০ জিলহজ্ব তারা পশু কুরবানী, শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ ও ফরজ তাওয়াফ সম্পন্ন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ মৌসুমে প্রতিবছর যারা হজ্ব করে আসেন তারা এক নতুন জীবনের শপথ নিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করে থাকেন। এ জীবন বড় আখিরাতমুখী, স্বপ্নময়।
হজ্ব একটি ফরয ইবাদত। নামায, রোযা, যাকাত যেমন ফরয ইবাদত, তেমনি সামর্থবান মুসলমানদের জন্য হজ্ব একটি অন্যতম বরকতপূর্ণ অবধারিত কর্তব্য। হজ্ব মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও ইজ্জতের আসন দান করে, সৌভাগ্যের দরোজা খুলে দেয় প্রকৃত হাজীর জীবনে।
পবিত্র বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত শরীফের একটি হাদীসে আছে, আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে পুরনুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, যখন তুমি হাজীদের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন তুমি তাকে সালাম করবে, মুসাফাহা করবে এবং তার বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বে তাকে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধ করবে। কেননা তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত।’ অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, মহানবী (স.) বলতেন, আল্লাহুম্মাগ ফিরিল হাজ্ব ওয়ালিমান ইস্তাগফির লাহুম।’ – হে আল্লাহ পরওয়ার দিগার তুমি হাজীদের মাফ করে দাও। আর তাদের মাফ করে দাও যারা তাদের জন্য দুআ ভিক্ষা করে।’ সব দিক বিবেচনা করে মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম হাজী সাহেবানের জন্য ৪ টি পুরষ্কার তুলে ধরেছেন।
হাজীদের জন্য চারটি পুরস্কার : ক) গুনাহ মাফ : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন রসুলে পাক (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করল এবং ঐ হজ্বের জন্য খায়েশাত সম্বলিত অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকল সে হজ্ব থেকে এমন নিষ্পাপ হয়ে ফিরল যেন সে আজই তার মাতৃগর্ভ থেকে আগমন করল।
খ) জান্নাতের সু-সংবাদ : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, এক উমরাহ অন্য আরেক উমরাহর মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ। আর মাবরুর হজ্বের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই হতে পারে না। উল্লেখ্য মাবরুর হজ্ব মানে মাকবুল হজ্ব। অর্থাৎ হাজী সাহেব হজে সমস্ত হুকুম আহকাম বজায় রেখে একান্ত আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এমন নিয়তে হজ্ব সুসম্পন্ন করবেন আর আল্লাহ কবুল করবেন।
গ) দরিদ্রতা দুর হওয়া : হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.)বলেছেন হজ্ব ও ওমরাহ গুনাহসমুহকে দূর করে দেয় ও ফকিরিকে মিটিয়ে দেয়। আগুনের ভাট্রি যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহার ময়লাকে দূর করে দেয়।
ঘ) শাফায়াত : একজন মাকবুল হাজী চারশত লোককে শাফায়াত করে জান্নাতী করার সৌভাগ্য লাভ করে।
আর হাজী সাহেব যখন উক্ত চার পুরস্কার নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে তখন চারজন শক্র তার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায়- নফস, শয়তান, আত্মীয়-স্বজন এবং বিবি-বাচ্চা। কুরআনে কারীম, হাদিস শরীফ ও মুহাক্কিক বুজুর্গানেদ্বীন হজ্বপরবর্তী জীবন পালনে নিম্নলিখিত সতর্কাবলি ব্যক্ত করেছেন।
১) হাজী হিসাবে নিজের নাম নিজেই প্রচার না করা এবং হজ্ব করার বিষয়ে গর্ব ও অহংকার না করা। কেননা এটি ফরয নামায আদায়ের মত একটি ফরয ইবাদত। চিরদিন নামায আদায় করেও কেউ নিজেকে নামাযী বলে পরিচয় দেন না। তবে সাধারণ মানুষ আদর্শ হাজীদেরকে আলাদা চোখে দেখে, তাদের ইমান আমল অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে বলে হাজী সাহেব বলে সম্বোধন করেন। এটি কোন দোষের বিষয় না। কারণ হজ্ব জীবনে মাত্র একবার এবং তা সবার জন্য সহজ নয়। সুতরাং হজ্ব করা কারো জীবনে একটি স্মরণীয় ও আলোচিত বিষয় এবং এ হাজী সাহেব সাধারণ মুসলমানের কাছেও শ্রদ্ধেয়, স্মরণীয় মডেল বৈকি। মক্কা মদীনা দুই শহরে এক অপরকে একটু সম্মান করতেই ইয়া হাজ- হাজী সাহেব! আর সম্মানিত মহিলা হলে তাকে অনায়াসে ডাক দেয় ইয়া হাজা! এটি কোন বাড়াবাড়িমূলক শব্দ নয়; বরং অত্যন্ত ভালো কালচার, পুত:সম্বোধন। আগেকার যুগের বহু মনীষী পন্ডিত স্কলারদের নামের আগে হাজী শোভা পেয়েছে।
২) পুরুষ হাজীদের মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত সর্বদা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামায়াত সহকারে আদায় করার চেষ্টা করতে হয়। দুনিয়ার কোন ব্যস্ততার কারণে নামায কাযা না করা। মহিলা হাজীদের উচিৎ আযানের পরপর কোন রকম বিলম্ব ছাড়া আউয়াল ওয়াক্তে ঘরে নামায আদায় করে নেয়া।
৩) ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআন-হাদীস অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (স.) এর নাফরমানী হয় এমন কাজ করা থেকে বেঁচে থাকা। বস্তুত এটাই হজের প্রকৃত দাবী। কারণ হজ্বের সময় বারবার লাখোবার স্বীকার করেছি ইন্নাল হামদা ওয়ান্নে’মাতা লাকা, লাকা ওয়াল মুলক…।
৪) রুজি-রোজগারে হালাল-হারাম মেনে চলা এবং সর্বদা হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা।
৫) নিজের পরিবারকে বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের ইসলামের আলোকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। তাদের মধ্যে দ্বীনের ইলম ও আমল সৃষ্টির চেষ্টা করা।
৬) প্রতিদিন কিছু সময় কোরআন-হাদীস ও ইসলামী বই-পুস্তক অধ্যয়নের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা। কেননা দ্বীনের সহীহ ইলম ছাড়া দ্বীন মেনে চলা সম্ভব নয় এবং এটি আমাদের উপর অন্যতম ফরয দায়িত্ব।
৭) নফল ইবাদত ও সার্বক্ষণিক যিকির আযকারের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সাথে গভীর সম্পর্কের অনুভূতি সৃষ্টি করা ও তার উপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করা।
৮) নবী করীম (সা.) ও তার মহান সাহাবাদের অনুসরণে সমাজে ইসলামের প্রচার ও প্রচলনের প্রয়াস চালানো।
৯) ঘরের সুকেস, শোরুম, ড্রয়িং রুম, অফিস রুম প্রভৃতি পবিত্র মক্কা শরীফ মদীনা শরীফসহ ধর্মীয় বিষয়ের ক্যালোগ্রাফিতে সাজানোর চেষ্টা করা, সর্বত্র ইসলামী ঐতিহ্যমন্ডিত এবং জ্ঞান উদ্ধীপ্ত বই পুস্তক ও জীবনালেখ্যের চোখ জুড়ানো সম্ভার গড়ে তোলা।
১০) আরাফাতী ভাইবোনদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করা, তাদের অসুখ বিসুখ, মৃত্যু, সুখ শোকে সাড়া দেওয়া, কাছে থাকা।
মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক,
টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।
পূর্বকোণ/আর