চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ফজিলতের মাস মহররম ও কারবালার চেতনা প্রসঙ্গে

১২ আগস্ট, ২০২২ | ১২:০৩ অপরাহ্ণ

দ্বিতীয় পর্ব। কারবালার হৃদয়বিদারক শোকাবহ ঘটনায় ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী মাতম, আহাজারি, বুক চাপড়ানোর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক পালন করা বা অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে আল্লাহতাআলা যে বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলেন সেজন্য বিজয়ের উল্লাস করার কোনটাকেই ইসলাম সমর্থন করে না। কোর্মা, পোলা ও খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ অন্ধভাবে অনুসরণ করার মধ্যে বিভ্রান্তি ছাড়া অন্যকিছু আছে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে।

 

হযরত হুসাইন(আ.) এর শাহাদতের পর থেকে তিনশত বছর পর্যন্ত ১০ মহররম কোন কান্নাকাটি, আহাজারি, চিৎকার ও বুক চাপড়ানি প্রথার অস্তিত্ব ছিল না। ৩৫২ হিজরিতে মুইযযুদ দাওলা দাইলামি (একজন শিয়া) মহরমে শুধু বাগদাদে হজরত ইমাম হুসাইনের জন্য মাতম করার হুকুম জারী করেন। (তিরমিজি)৩৬৩ হিজরিতে মিশরেও এই হুকুম জারী করা হয়। সেই থেকে কোন কোন স¤প্রদায়ের মাঝে এই প্রথা চালু হয়। পাকিস্তান, আফগানিস্থান, ইরান, ইরাক, লেবানন ও বাহরাইনে এইসব অনুষ্ঠান বেশী দেখা যায়। আশুরার আমলের সাথে এইগুলি সম্পৃক্ত ঘটনা নয়। কারণ রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের আগে আমাদের শরীয়ত পূর্ণ হয়ে গেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শরীয়ত, শরীয়তের দলিল ও শরীয়তের দলিলের উৎসসমূহ আল্লাহতাআলা নিজে হেফাজতের ঘোষনা দিয়েছেন। এই শরীয়ত যেভাবে আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে আজ পর্যন্ত সেভাবে সংরক্ষিত আছে। তাতে কোন ধরণের সংযোজন বিয়োজনের সুযোগ নেই। এপ্রিল ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ, মুয়াবিয়া কর্তৃক ইয়াজিদকে খলিফা ঘোষণা করা হয়। ইয়াজিদ মদিনার গর্ভনরকে তাৎক্ষণিকভাবে হুসাইন ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য (বায়াত) আদায়ের জন্য নিদের্শ দেয়। কিন্তু হুসাইন ইবনে আলী তা প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, তিনি মনে করতেন যে, ইয়াজিদ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে এবং মুহাম্মদের সুন্নাহকে পরিবর্তন করছে। তার সম্পর্কে বলা হয় যে সে মদ্যপানকে বৈধ ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল। শাসক হিসাবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। ইমাম হুসাইন এজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকৃত হন এবং ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে তাঁর পরিবারের সদস্য, সন্তান, ভাই এবং হাসানের পুত্রদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় চলে যান।

অপরদিকে কুফাবাসী যারা মুয়াবিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে অবগত ছিল তারা চিঠির মাধ্যমে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য হুসাইনকে অনুরোধ করেন এবং উমাইয়াদের বিপক্ষে তাকে সমর্থন প্রদান করে। প্রত্যুত্তরে হুসাইন চিঠির মাধ্যমে জানান যে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি মুসলিম ইবনে আকীল কে পাঠাবেন। যদি তিনি তাদের ঐক্যবদ্ধ দেখতে পান যেভাবে চিঠিতে বর্ণিত হয়েছে সেরূপ, তবে খুবই দ্রুতই যোগ দিবেন, কারণ একজন ইমামের দায়িত্ব হচ্ছে কুরআন বর্ণিত অনুসারে কাজের আঞ্জাম দেওয়া, ন্যায়বিচার সমুন্নত করা, সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজেকে স্রষ্টার নিকট সঁপে দেওয়া। মুসলিম ইবনে আকীলের প্রাথমিক মিশন খুবই সফল ছিল এবং ১৮০০ এর অধিক ব্যক্তি শপথ প্রদান করেছিল। কিন্তু অবস্থা ইতিমধ্যে পরিবর্তন হয়ে যায়। উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দেন এবং মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন। আকীলের মৃত্যুর খবর পৌঁছার আগেই হুসাইন ইবনে আলী কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রারম্ভ করে দেন। পথিমধ্যে হুসাইন খবর পান যে আকীলকে কুফায় হত্যা করা হয়েছে। তিনি খবরটি তার সমর্থকদের জানালেন এবং তাদের বললেন যে জনগণ তাঁর সাথে প্রতারণা করেছে। তিনি কোন সংশয় ছাড়াই তাঁর সাথীদের তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে বললেন। অধিকাংশ সঙ্গী তাঁকে ছেড়ে চলে যায় নিকটাত্মীয়রা ছাড়া।

 

যাই হোক কুফার যাত্রাপথে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের সাথে তাঁকে (হুসাইন) মোকাবেলা করতে হয়। কুফাবাসীগণ ইমামবিহীন থাকার কারণে তাঁকে (হুসাইন) আমন্ত্রণ করেছিল সে প্রতিশ্রুতির কথা কুফার সেনাবাহিনীকে স্মরণ করতে বললেন। তিনি বললেন যে, কুফাবাসী সমর্থন করেছিলো বলেই তিনি যাত্রা করেছেন। কিন্তু তারা যদি তাঁর (হুসাইন) আগমনকে অপছন্দ করে তবে তিনি (হুসাইন) যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যাবেন। তবে সেনাবাহিনী তাঁকে (হুসাইন) অন্য পথ অবলম্বন করতে বললেন। এতে করে, তিনি (হুসাইন) বাম দিকে যাত্রা করলেন এবং কারবালায় পৌঁছে গেলেন। সেনাবাহিনী তাঁকে (হুসাইন) এমন এক জায়গায় অবস্থান নিতে বাধ্য করল যে জায়গাটি ছিল পানিশূন্য। সেনাপ্রধান উমার ইবনে সাদ হুসাইনের আগমনের উদ্দেশ্য বুঝার জন্য দূত প্রেরণ করলেন। হুসাইন জানালেন যে তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে এসেছেন কিন্তু তারা যদি অপছন্দ করে তবে তিনি ফিরে যেতে প্রস্তুত রয়েছেন। যখন এই প্রতিবেদন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌছল তখন তিনি সাদকে হুসাইন ও তার সমর্থকদের ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য আদায়ের নির্দেশ দিলেন। তিনি এই নির্দেশ ও দিলেন যে, হুসাইন ও তার সঙ্গীরা যাতে কোন পানি না পায়। পরের দিন সকালে উমার বিন সাদ তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। আল হুর ইবনে ইয়াজিদ আল তামিম সাদের দল ত্যাগ করে হুসাইনের সাথে যোগ দিলেন। তিনি কুফাবাসীদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নবীর দৌহিত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভৎসর্ণা করলেন। অতঃপর যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

কারবালার যুদ্ধ সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দিনটি ছিল ১০ ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ (মুহাররম ১০, ৬১ হিজরি) এই যুদ্ধে প্রায় ৭২ জন নিহত হন যাদের সকলেই পানি বঞ্চনার শিকার হন। অর্থাৎ সকল পুরুষ সদস্যই নিহত হন কেবলমাত্র রোগা ও দুর্বল জয়নুল আবেদিন ছাড়া। এটি এক অসম যুদ্ধ ছিল। যেখানে হুসাইন ও তার পরিবার বিশাল এক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

 

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবু রায়হান আল বিন্নী এর মতে, তাবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং মৃতদেহগুলোকে ঘোড়ার খুড় দ্বারা ক্ষতবিক্ষত ও পদদলিত করা হয়; মানব-ইতিহাসে কেউ এমন নৃশংসতা দেখেনি। হত্যার আগমুহূর্তে হুসাইন বলেন, ‘আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যদি মুহাম্মদের দ্বীন জীবন্ত হয়, তবে আমাকে তরবারি দ্বারা টুকরো টুকরো করে ফেল।’ উমাইয়া সৈন্যরা হুসাইন ও তাঁর শিশুপুত্র ও পুরুষ সঙ্গীদের হত্যা করার পর সম্পদ লুট করে, মহিলাদের গয়না কেড়ে নেয়। শিমার জয়নুল আবেদীনকে হত্যা করতে চাইলে জয়নাব বিনতে আলী এর প্রচেষ্টায় কমান্ডার উমার ইবনে সাদ তাকে জীবিত রাখেন। তাকেও (জয়নুল আবেদীন) বন্দী নারীদের সাথে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতিহাসের বর্বরোচিত, নির্মম এ জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মহরমের আশুরাকে অনেক বেশী তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে যে কারণে আশুরা বললেই মহরমের এ ঘটনাকেই বোঝানো হয়। বছরে যে চারটি মাস মুসলমানদের কাছে পবিত্র তারমধ্যে সবার উপরে এই মাসের অবস্থান। হারাম শব্দটি থেকে মুহররম শব্দটি এসেছে। হারাম শব্দের অর্থ পাপ আর যে পাপ এ মাসে সংঘটিত হয়েছিলো সেটা স্মরণ করেই মুসলিম সম্প্রদায় মুহররম পালন করে থাকে। এটা কোন উৎসব নয়। শোকাবহ ১০ মুহররম ৬৮০ হিজরির দিনটিকে স্মরণ করে এই দিনটি পালন করা হয়। (সমাপ্ত)

সৈয়দা সারওয়ার জাহান চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) বাংলাদেশ রাবার বোর্ড।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট