চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

হিজরি সন : মুসলমানদের ঐতিহ্য-গৌরবের স্মারক

মাওলানা গোলামুর রহমান আশরফ শাহ

৩০ জুলাই, ২০২২ | ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের কোটি মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরবের স্মারক হিজরি সন। মুসলমানদের সমৃদ্ধ কৃষ্টি সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করে আছে হিজরি সন। খ্রিস্টিয় ও বাংলা এই দুটি প্রচলিত স্বতন্ত্র সনের মতোই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিজরি সন ও তারিখ মেনেই বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমের প্রাত্যহিক জীবনধারা আবর্তিত হয়ে আসছে। হিজরত শব্দটি থেকেই ‘হিজরি’। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কার মাতৃভূমি থেকে মদিনায় হিজরত তথা পদার্পণের ঘটনাকে স্মরণীয় ও মহিমান্বিত করতেই হিজরি সনের উদ্ভব ঘটে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পবিত্র হজ, ১০ মহররম আশুরা, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.), ঈদে মিরাজুন্নবী (দ.), শবে বরাত, শবে কদর, খোলাফায়ে রাশেদার ওফাতবার্ষিকীসহ ইসলামী তাৎপর্যম-িত দিনগুলো হিজরি সন-তারিখ মেনেই উদযাপন করেন মুসলমানরা। ইসলামী দিবস ও নানা আচার আনুষ্ঠানিকতা হিজরি তারিখ অনুসরণে উদযাপিত হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে, যুগ যুগান্তরে। হিজরি সন তাই হয়ে ওঠে মুসলমানদের ঐতিহ্য, গৌরব ও কৃষ্টি সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে। খ্রিস্টিয় ও বাংলা সন-তারিখ যেমন আমরা নানা পালা-পার্বণে, উৎসবে আনুষ্ঠানিকতায় মেনে চলি, তেমনি হিজরি সন ও তারিখ মেনে ইসলামী দিবস ও আনুষ্ঠানিকতা আমরা পালন করি। খ্রিস্টিয় সন যেমন সারা বিশ্বে অনুসৃত হয়, তেমনি দেশে দেশে কোটি মুসলমানের জীবনধারা পরিচালিত হয়ে আসছে হিজরি সন ও তারিখকে ঘিরে। তাই, হিজরি সনের গুরুত্ব ও আবেদন কোনো অংশে কম নয়। এমনকি মুসলমানদের জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই হিজরি সন।

হিজরি সন মুসলমানদের স্বতন্ত্র সন। যা ইসলামের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যই তুলে ধরে। ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন, মুসলমানদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি যে কতো সমৃদ্ধ হিজরি সন তাই প্রমাণিত করে। হিজরি সন প্রবর্তিত হয়েছে বলেই মুসলমানদেরকে সন তারিখ গণনায় অন্য সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না। মহানবীর (দ.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সতের বছর পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (র.) এর শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। হিজরি সন প্রবর্তনের আগে মুসলমানরা তৎকালীন আরবে প্রচলিত নানা সন রীতি মেনে জীবনধারা পরিচালিত করতো। এসব বর্ষ গণনা পদ্ধতির বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আরবরা তাদের গোত্রের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির স্মরণে বা কোনো দুর্ঘটনাকে স্মরণ করে বছর গণনা করতো। এর কোনো সর্বজনীনতা ছিল না। নির্দিষ্ট পরিম-লে সীমিত জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থে এসব সন গণনার রেওয়াজ ছিল। তাই, সর্বজনীন জনগোষ্ঠীর স্বার্থে একটি নতুন সন প্রবর্তনের দাবি তখন বেশ জোরালো হয়ে ওঠে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরিফে হিজরতের পর তাঁর নেতৃত্বে মদিনাকেন্দ্রিক সর্বজনীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন রাষ্ট্রীয় পরিম-লে প্রশাসনিকভাবে অনুসৃতির জন্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু না থাকায় রাষ্ট্র পরিচালনায় সন-তারিখ হিসাব রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। মদিনার কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার বাইরেও বিভিন্ন প্রদেশের শাসন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা দেয় নানা বিড়ম্বনা। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য তখন নতুন একটি সন প্রবর্তনের তাগাদা অনুভব করেন বিভিন্ন প্রদেশের শাসক ও গভর্নরগণ। নতুন একটি সন প্রবর্তনের তাগিদ দিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মহানবীর (দ.) কাছে চিঠিপত্র লিখতে থাকেন। তৎকালীন সময়ের কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) খলিফা হযরত ওমরের (রা.) কাছে নতুন একটি সনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে একটি চিঠি লিখেন। অন্যান্য সাহাবিরাও এ ব্যাপারে অভিন্ন দাবি তুলেন।

চিঠিতে তাঁরা লিখেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে খলিফা কর্তৃক যেসব নির্দেশনা, পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় তাতে নির্দিষ্ট কোনো সন তারিখ উল্লেখ না থাকায় সময় ও কাল নির্ধারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপকভাবে এ ধরনের দাবি ও অভিযোগ শুনে খলিফা হযরত ওমর (রা.) সিনিয়র সাহাবি ও সুধীজনদের সঙ্গে পরামর্শ ও মতবিনিময়ে মিলিত হন। ব্যাপক মতামত ও আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে তাঁরা নতুন একটি স্বতন্ত্র সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। তবে কখন থেকে নতুন সন প্রবর্তিত হবে, এই সনের নাম কি দেওয়া যায় তা নিয়েও বৈঠকে বিশেষ আলোচনা ও মতামত ওঠে আসে। অবশেষে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর প্রস্তাব মতে হিজরতের ঘটনাকে স্মারক ধরে নতুন হিজরি সন প্রবর্তনের ব্যাপারে তাঁরা মতৈক্যে পৌঁছেন। মহানবীর (দ.) হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে হিজরি সন গণনার জন্য নির্ধারণ করা হয়। আর তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান জুন্নুরাইনের (রা.) প্রস্তাবে সকল সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য মহররম থেকে হিজরি সন গণনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। হিজরি সন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু হয় দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফতের সময় সপ্তদশ হিজরির ১০ জমাদিউল আউয়াল, ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রবর্তনের পর থেকেই এই হিজরি সন মুসলিম শাসক ও বিজয়ীদের মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়ায় পৌঁছে যায়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় দুইশ কোটি মুসলমানের বসবাস। এই বিপুলসংখ্যক মুসলমানের প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও সংস্কৃতি হিজরি সন ও তারিখ ঘিরে পালিত হয়। তাই, বলা চলে হিজরি সন একটি আন্তর্জাতিক সন। এর আন্তর্জাতিকতা ও ব্যাপক আবেদন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অতীব দুঃখজনক যে, বহু মুসলিম দেশে হিজরি নববর্ষ সাড়ম্বরে পালিত হয় না। আমাদের প্রিয় এই স্বদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের জীবনধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে থাকা ১ মহররম হিজরি নববর্ষ পালনে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। ১ জানুয়ারি খ্রিস্টিয় নববর্ষ উদযাপনের নামে থার্টি ফার্স্ট নাইটে মধ্যরাতে যে হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠে যুব-তরুণরা- তা কিন্তু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি নয়। এটি ভিনদেশি আমদানি করা সংস্কৃতি। থার্টি ফার্স্ট নামে খ্রিস্টিয় নববর্ষ পালনে যুব তরুণদের ব্যাপক বাড়াবাড়ি ও উন্মাদনা অবশ্যই বিকৃত সংস্কৃতি। পঁচাশি ভাগ মুসলমানের এই দেশে এমন বিকৃত আবেদনময়ী অপসংস্কৃতি বাধাহীনভাবে চলতে দেয়া যায় না। বাংলা ও খ্রিস্টিয় নববর্ষের মতোই বরং এর চেয়েও ধুমধামে উৎসবমুখর পরিবেশে সুস্থ নির্মল সংস্কৃতির মাধ্যমে হিজরি নববর্ষ উদযাপিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। তবে অতীব সুখবর যে, জাতীয় চেতনাম-িত, উজ্জীবনধর্মী ও ইসলামী সংস্কৃতির মাধ্যমে হিজরি নববর্ষ পালনে চট্টগ্রাম ইতিমধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

 

২০১০ সনে চট্টগ্রামে দেশে প্রথমবারের মতো বৃহৎ আয়োজনে হিজরি নববর্ষ পালন করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রট। পরবর্তী বছর ২০১১ সনে সমমনা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী কয়েকজন সংগঠক মিলে গঠন করেন হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ। করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সনে ঘটা করে দুই বছর হিজরি বর্ষ উৎসব পালন করা যায়নি। তবে সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। মহান আল্লাহর রহমতে এখন করোনার অমানিশা ধীরে ধীরে দূরীভূত হচ্ছে। তাই এবার ২০২২ সনে হিজরি নববর্ষ ১৪৪৪ একটু বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করা হচ্ছে। আগামি কাল চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর আপন গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারে হিজরি নববর্ষ উদযাপিত হবে। আয়োজনে থাকছে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ। হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের দ্বারা গঠিত হলেও জাতীয়ভাবে হিজরি নববর্ষ পালনে হকপন্থি উলামা মাশায়েখসহ শীর্ষস্থানীয় সংগঠকদের এগিয়ে আসা উচিত। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা দরকার। এখন প্রয়োজন জাতীয় হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ নামে কেন্দ্রীয় একটি প্লাটফরম।

সম্ভাবনাময়ী যুব তরুণ সমাজ আজ নানাভাবে অবক্ষয়-অনৈতিক কর্মকা-ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। হাত বাড়ালেই মিলছে নানা মাদকপণ্য। তাদেরকে অবক্ষয়-অনৈতিকতার গ্রাস থেকে ফেরানোর বড় কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। হিজরি নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে সুস্থ নির্মল উজ্জীবনধর্মী সংস্কৃতিকে মেলে ধরার এ ধরনের আয়োজন সারা দেশে এমনকি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে পথের দিশা পাবে যুব সমাজ। এগিয়ে যাবে দেশ আলোর পথে। সারা দেশে এমনকি সারা বিশ্বে নির্মল সুস্থ মননধর্মী সংস্কৃতি চর্চা বেগবান হোক। ইসলামী ও দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে সুস্থ নির্মল সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটিয়ে ঘুণে ধরা সমাজ বদলে দিতে হবে। ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে যুব তরুণদের মানসচেতনা গড়ার বহুমাত্রিক উদ্যোগ নেয়া আজ সময়ের দাবি। তাই আসুন! নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতিতে জীবন গড়ি। হিজরি নববর্ষ পালন করি।

দেশে দেশে চলছে আজ হানাহানি যুদ্ধ সংঘাত। দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর হায়েনার মতো হামলে পড়ছে সবল দেশগুলো। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইয়েমেনে সৌদি আরবের নির্মমতা, সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণ সংঘাত এখনো থামেনি। ফিলিস্তনি মুসলমানদের ওপর চলছে ইসরাইলি দমন নিপীড়ন নৃশংসতা। কাশ্মীর আজ ভয়াল জনপদের নাম। কাশ্মীরি মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার। তারা লড়াই করছে স্বাধিকারের জন্য। কিন্তু কে শুনবে কাশ্মীরিদের এই আর্তনাদ! যুদ্ধ-সংঘাত পুরো পৃথিবীকে অশান্ত করে রেখেছে। শ্রীলংকা-আফগানিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্য ও খাদ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। গোটা দুনিয়ায় আজ মানবতার চরম বিপর্যয় চলছে। এই চরম দুঃসময়ে এসেছে হিজরি নতুন বছর। হিজরি ১৪৪৪ নববর্ষ পৃথিবীতে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করুক। দূরীভূত হোক সংঘাত-অশান্তির কালো মেঘ। একটি মানবিক সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ হোক-হিজরি নতুন বছরে এই প্রত্যাশা থাকলো।

মাওলানা গোলামুর রহমান আশরফ শাহ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট