চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভক্ত থেকে বোন  

সালমা আনজুম লতা

২৩ জুন, ২০২১ | ১:২৭ অপরাহ্ণ

২০০৯ সালে ফেসবুক একাউন্ট খুললেও ফেসবুকে আমার বিচরণ ছিল খুবই কম। গত এক যুগে বন্ধুর সংখ্যা হয়েছে মাত্র ৮২৫ জন। লেখালেখি করার সুবাদে ফলোয়ারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বেশ কয়েকটা গ্রুপের সদস্যও হতে হয়েছে। তবে আমার পছন্দের কয়েকটা গ্রুপে নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলাম। পাঠকদের উৎসাহ আর অনুরোধে লেখালেখি করাটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বয়সের কারণে নিজের নানা অভিজ্ঞতাও শেয়ার করতে ইচ্ছে করে। নতুন প্রজন্মের জন্য নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে লেখাটা যেন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে গেছে।

আমার কোন কোন লেখা পোস্ট করার পর অভাবনীয় সাড়া পাই। দারুণ সব কমেন্ট আর লাইক পেয়ে আপ্লুত হই। নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে লেখার তাগিদ অনুভব করি। অনুপ্রেরণা পাই।কিছু কিছু পাঠক নিয়মিত কমেন্ট করেন। এত মানুষের ভীড়ে তাদের সবার নাম মনে থাকার কথা নয়। তবে নিয়মিত আমার লেখা যারা পড়েন, লাইক দেন কিংবা সবসময় যারা কমেন্ট করেন তাদের নাম দেখলেই চেনা চেনা মনে হয়। কাউকে কাউকে খুব আপন মনে হয়।

তেমনই একজন Shumi Ashraf আমার প্রায় সব লিখাই পড়তেন, সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করতেন। ঠিক কত আগে থেকে আমার লিখা পড়ে যাচ্ছিলেন আমি জানিনা।একসময় ওনার কোন একটা কমেন্ট পড়ে আমার মনে হল উনি সেনা অফিসারের নিকট আত্মীয়। সেনা পরিবারের প্রতি স্বভাবতই আমাদের একটা দুর্বলতা আছে। আমি পাল্টা উওর দিয়ে ওনার পরিচয় জানতে চাইলাম। সঙ্গত কারণেই উনি উত্তরটা কমেন্টে না দিয়ে সরাসরি ইনবক্সে চলে এলেন।পরিচয় দিলেন। এক সময় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন। আমার লেখার ভক্ত আর আর্মি অফিসারের আত্মীয় হিসেবে আমি সহজেই তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলাম।

পরিচয় থেকে আলাপচারিতা। আপনি দিয়ে শুরু করলেও সুমির বয়স জানার পর আর ইচ্ছে হলো না ওকে আপনি করে বলি। আপনি থেকে ‘তুমি’ হয়ে গেল। একসময় জানলাম আমার এই জুনিয়র বন্ধুটি আমার মতই আপনজন ছেড়ে আমেরিকাতে বসবাস করছে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর। একটু একটু করে ওর সাথে সম্পর্কটা গভীর হয়, বাড়ে সখ্যতা। এক সময় আমি হয়ে যাই ওর আপা। আমার নিজের ছোট ভাইবোন নেই। কেউ আন্তরিকভাবে ‘আপা ‘ বললে কেমন যেন দুর্বল হয়ে যাই। আমিও ওকে ছোট বোনের মত ভালবাসতে শুরু করি। নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করি।এভাবেই সুমির মায়ায় জড়িয়ে যাই।

কয়েকদিন কথা না হলেই আমাকে সরাসরি ফোন করে আমার খোঁজখবর নেয়। নানারকম গল্প করতে করতে প্রায়ই বলে, ‘ আপা আমাদের এখানে একবার বেড়াতে আসেন, ঘুরে যান ‘। এমন করে আন্তরিকভাবে অনেকেই বলে। কিন্তু সময় সুযোগ না হলে যাই কী করে ? তাছাড়া এত দূর ! কথায় কথায় জানতে পারি ও এলাবামার মোবিল শহরে থাকে।

‘জানো? আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও এলাবামার হান্টসবিল-এ থাকে।আমাকে ওর ওখানে বেড়াতে যেতে বলে। যাবো যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না।’

‘আপা, আপনি যখন আপনার ওই বন্ধুর বাসায় আসবেন তখন আমার বাসায়ও বেড়াতে আসবেন।’

‘তোমার বাসাতো হান্টসভিল থেকে অনেক দূরে , কেমন করে আসবো ?’

‘আমরা আপনাকে গিয়ে নিয়ে আসবো। আবার দিয়ে যাবো।’

৩৬০ মাইল দূরে এসে আমাকে নিয়ে যাবে? এও কি সম্ভব! আত্মীয় নয়, স্বজন নয়। অনেক দিনের পুরনো বন্ধুও নয়। তখনো বুঝিনি ও আসলে আমাকে কতটা শ্রদ্ধা করে, কতটা ভালোবাসে। কতটা আপন ভেবেই কথাগুলো বলেছিল।

মে মাসের প্রথম দিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু Mahbub Hasan এর বাসায় বেড়াতে আসার প্ল্যান করলাম। জুন মাসে টিকিটও করে ফেললাম। মনে মনে ঠিক করলাম ছোট বোন সুমির বাসায়ও যাবো। বন্ধুর বাসায় গিয়ে যখন শুনলাম ছয় ঘন্টার ড্রাইভ তখন ভাবনায় পড়ে গেলাম। এত দূরের পথ একবার আমাকে নিয়ে যাবে, আবার দিয়ে যাবে ? চারবার ৩৬০ মাইল আসা যাওয়া। তারচাইতে এক কাজ করলে কেমন হয় ? হান্টসভিল থেকে বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে নিয়ে সবাই মিলে একসাথে যাই, দু’দিন বেড়িয়ে আসি। তাহলে আনন্দও বেশি হবে। বন্ধুকে বলার পর ওরাও রাজী হয়ে গেল।

১৮ই জুন জুম্মা পড়ে সরাসরি মসজিদ থেকেই রওয়ানা হলাম। রাত সাড়ে আটটায় পৌঁছালাম। এই প্রথম এতদিনের অদেখা বোনটিকে কাছ থেকে দেখলাম। হাত মুখ ধুয়ে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে যখন টেবিলে গেলাম। ওর আয়োজন দেখে আমি বাকরুদ্ধ ! বাসায় তখন ওর আপন ছোট বোন দিনা, দুই মেয়ে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। এত ঝামেলার মধ্যেও কেমন করে এত কিছু রান্না করেছে। আমি বার বার ওর দিকে তাকাই। ওর কন্ঠস্বর, ওর চালচলন, ওর চঞ্চলতা দেখে আমি ভাবনার গভীরে ডুবে যাই। এত সহজেই সুমি আমাকে এত ভালবেসে ওর বোনের জায়গায় স্থান দিয়েছে। কী অসীম মমতা নিয়ে জন্মেছে আমার অদেখা এই বোনটি। আপা আপা করে আমাকে অস্থির করে ফেললো।

১৮ , ১৯, ২০ জুন এই তিন রাত সুমির বাসায় ছিলাম। তিনদিন সুমি আর ওর বর আজাদ আশরাফ কাশ্মীর আমাদের জন্য যা করেছে তা অবর্ণনীয়। আমাদেরকে তিনটা স্টেটের বিশেষ বিশেষ দর্শনীয় স্থানে নিয়ে গেছে। লুইজিয়ানার French quarter, museum, University of Southern Mississippi, Dauphin Island, ফ্লোরিডার Pensacola beach, University of South Alabama.

আমাদের সম্মানার্থে ২০ শে জুন রাতে বাসায় ডিনারের আয়োজন করেছিল। মোবিল শহরের বেশ কিছু পরিবারকে দাওয়াত করেছিল শুধুমাত্র আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। আমি শাহরিয়ার নাফীসের মা। সে কারণে নাফীসের ভক্তরাও হাযির হয়েছিল। কিন্তু আমি মনে করি মোবিলে আমার বড় পরিচয় আমি সুমির আপা।

পরদিন সকালে নাস্তা করে চলে আসার কথা। বারবার অনুরোধ করছিল দুপুরে যেন খেয়ে আসি। আমাকে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে ওর বাগানের কচু শাক খাওয়াবে, চ্যাঁপা শুটকি দিয়ে কুমড়া পাতার বড়া, ওর গাছের বেগুন আরো কত কী। আমি বুঝতে পারছিলাম এত আপ্যায়ণ করেও ওর মন ভরেনি। ওকে অতৃপ্ত রেখেই বিদায় নিতে হল।

অনেকবার সুমিকে জড়িয়ে ধরলাম, কপালে চুমু খেলাম, ওর গায়ের গন্ধ নিলাম। ছোট্ট শিশুর মত সুমিও আমার বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি পাচ্ছিল। বার বার মনে পড়ছিল আমার আর এক আত্মার বোন ট্যাম্পার ভক্ত থেকে বোন Mahbuba Alam স্বপ্নার কথা। গত তের দিন বন্ধুপত্নী লিপির সাথে আছি। দু’দিন পর ওকেও ছেড়ে যাবো সেসব কথা ভেবে নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না। ওরা কেন আমাকে এত ভালবেসে মায়ায় জড়িয়ে ফেললো ? শুধু সুমি নয়। মাত্র দু’দিনের পরিচয়ের সুমির বোন দিনার জন্য, সুমির বর কাশ্মীরের জন্যও কষ্ট হচ্ছিল।

জানিনা আবার কবে দেখা হবে , কিংবা হবে কিনা এসব ভাবতে ভাবতেই ওদেরকে পেছনে ফেলে চলে আসলাম। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। ওদিকে দিনা আর সুমির চোখের পানি বলে দিল ওরা শুধু আমার ভক্তই নয়, ওরা আমার আদরের ছোট বোন। 

লতা। হান্টসভিল, এলাবামা থেকে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট