চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

`স্বাধীনতার ৫০ বছরেও অধরা মুক্ত গণমাধ্যম’

৪ এপ্রিল, ২০২১ | ৮:০৮ অপরাহ্ণ

দেশে গণমাধ্যমের বিকাশ অভূতপূর্ব। অর্ধশত টেলিভিশন, ডজন খানেক এফএম রেডিও, কয়েকশ’ জাতীয় দৈনিক, শতশত আঞ্চলিক পত্রিকা এবং অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল। রাষ্ট্র বোঝাতে চায়, এই সংখ্যাধিক্যই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার প্রমাণ। বাস্তবে সংখ্যার বেশ উন্নতি হলেও মানে বেশ পিছিয়ে যাওয়ায় মানুষ সংবাদমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। একই খবরের বারবার চর্বিত চর্বনে নাগরিকরা ত্যক্ত বিরক্তও। তাই গণমাধ্যম এখন গভীর সংকটে। এরসাথে জড়িতরা যেমনি জানেন, তেমনি জানেন, নাগরিক সমাজও।

ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের বোঝা এবং পক্ষান্তরে আয় কমে যাওয়া সংবাদ মাধ্যমকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। মালিকরা আয় কমে যাওয়ায় এখন ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিয়েছেন। গণমাধ্যমের বহুমাত্রিক সংকটে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। যেখানে যাছাই বাছাই ও সম্পাদনা ছাড়াই তথ্য ও মতামতের তাৎক্ষনিক আদান-প্রদান ঘটছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, দক্ষকর্মশক্তি এবং দরকারি বিনিয়োগের অভাবে সংবাদমাধ্যম এখন আর গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারছেনা। বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

দেশে ভালো কথা বলা সাংবাদিকের অভাব নেই। অভাব শুধু সেই কথামতো কাজ করার। নাগরিকরা পোষমানা সাংবাদিক চায় না। সাংবাদিকদের কোনো পক্ষ নাই। অনেকে অন্যায় করেন। আবার বুক ফুলিয়ে চলেন। তারা এটাও জানেন না, অন্যায় করে লজ্জিত না হওয়াটাও অন্যায়। সবাই যদি বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেন। তাহলে সমাজ আবার বর্বর যুগে ফিরে যাবে। তাই আইন-আদালতের দরকার হয়েছে মানুষকে সভ্য করে তোলার জন্য। এর ভাল-মন্দ রচিত হয় দেশ ভেদে ব্যবহারের ওপর। ব্যাক্তি হিসেবে একজনের সাথে মিথ্যা বললে সেটি না হয় খাটে। আর যখন আপনি সাংবাদিক হিসেবে গণমাধ্যমে একটি বিষয় তুলে ধরছেন, সেটি যদি মিথ্যা হয় কোটি কোটি মানুষের সামনে নিজে হেয় হচ্ছেন। কলংকিত করছেন গণমাধ্যমকে। অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে নয়, শোধরাতে হয় ন্যায় দিয়ে।

ভূত যেমন জলাশয়ের কাছে থেকে রাত-বিরাতে কোনো পথচারীকে একা পেলে পথ ভুলিয়ে অন্য পথে নিয়ে যায়, একইভাবে এরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার্থে পাঠককে বিভ্রান্ত করে, পথ ভুলিয়ে প্রায়ই অন্য পথে নিয়ে যায়। তাদের কারণেই দেশ ইমেজ সংকটে পড়ে। সংবাদপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন অস্বাভাবিক পথ কিংবা গুজব অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। যা কারো কাম্য নয়। দেশ-জাতির জন্যও মঙ্গলজনক নয়। আজ আমরা ন্যায়-অন্যায় ভাবছি না বলে আর্থিক উন্নতির পরও শান্তি-স্বস্থিতে আছি কয়জন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি আমার। প্রযুক্তিগত অনেক পরিবর্তন এসেছে। মান বেড়েছে কতোটা? আমাদের গণমাধ্যম এখনো সাবালক হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক চ্যানেলে সম্পাদকীয় বিবেচনাবোধ খুবই নিচুমানের। সবাই একধরনের সিন্ডিকেট মেনটেইন করে। লুটেরা পুঁজি বিনিয়োগের কারণে কি এই অবস্থা?

পেশাদার হওয়ার জন্য কোনো তাগিদ নেই। ওপরের দিকে গুটিকয়েক লোক মধু খায়, নিচের দিকের লোকেরা ঠিকমতো বেতন পায় না। ছাঁটাইয়ের খড়গ ঝুলে সবসময়। সেজন্য মেধাবী ছেলেমেয়েরা আসেনা। এলেও অপদার্থদের ভিড়ে টিকতে পারেনা।

দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন সব জায়গার মতো সংবাদ মাধ্যমেও দুর্বৃত্তায়নের চরম নমুনা দেখা যায়। বেশির ভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া কোনো-না-কোনো করপোরেট হাউজের মালিকানাধীন। তারা মূলত গণমাধ্যম না হয়ে সেই সব করপোরেট প্রতিভূর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার মাধ্যম হয়ে পড়েছে এবং নিজ নিজ করপোরেট দৈত্যের কল্কি বহন করছে। ফলে তৈরি হয়েছে করপোরেট সাংবাদিক।

সংবাদ মাধ্যমের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা যেমন অনেক বেশি। তেমনি দায়িত্বের ব্যাপ্তিও অনেক বিস্তৃত। সংবাদ মাধ্যম এই দায়িত্ব প্রত্যাশামতো পালন করতে পারে তখন, যখন নির্ভয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। তাই মুক্ত সাংবাদিকতার আবশ্যিক শর্ত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন।

সংবাদ মাধ্যমের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা যেমন অনেক বেশি। তেমনি দায়িত্বের ব্যাপ্তিও অনেক বিস্তৃত। সংবাদমাধ্যম এই দায়িত্ব প্রত্যাশামতো পালন করতে পারে তখন, যখন নির্ভয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। তাই মুক্তসাংবাদিকতার আবশ্যিক শর্ত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন।

একটি সভ্য দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এর সাংবাদিক সমাজ। কোনো দেশের সাংবাদিক সমাজ যখন দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখে, তখনই সেই দেশ এগিয়ে যায়। সাংবাদিকরা যখন মন্দ পথে হাঁটেন, তখন সেই দেশও মন্দের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। সংবাদপত্র হচ্ছে আয়নার মতো। আয়না কখনো মিথ্যা বলে না। যে আয়না মিথ্যা বলে, সেটি আয়না নয়, অন্য কিছু। তার মানে হচ্ছে, যে সংবাদপত্র মিথ্যা বলে, সেটি হলুদ সাংবাদিকতা যুক্ত।

রাষ্ট্র যখন স্বল্প কিছু লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে অর্থাৎ অতি ধনী বানাতে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট হয়, তখন তাকে আরও বেশ কয়েকটি কাজ করতে হয়। প্রথমেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত একটা অংশকে যা ইচ্ছে তাই করার লাইসেন্স দিতে হয়। যারা চেঁচামেচি বা প্রতিবাদ করে বা বাধার সৃষ্টি করে, তাদের ছলেবলে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। এই তালিকার প্রথমেই থাকে আদালত ও সংবাদমাধ্যম। তারপর মনোবল ভেঙে দিতে হয় ছাত্রছাত্রীদের—সাধারণত জেল–জুলুম, মারপিট, ভয়-ব্ল্যাকমেল ইত্যাদি পরীক্ষিত ব্যবস্থায়। এরপরে আসে ব্যবসায়িক আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৫২তম। টানা পরপর তিন বছর ধরে এ পতন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ যে শুধু পিছিয়েছে, তা-ই নয় প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে, এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও।

তাই আজ (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে অসুস্থ সাংবাদিকতার চিকিৎসা দরকার মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দামি জামা-কাপড় পরিয়ে সুস্থ দেখানোর প্রচেস্টা ভবিষ্যতে বুমেরাং হবে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে বিকলাঙ্গ তবে এই পেশা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তথা গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনই নিশ্চিত করতে পারে মুক্ত গণমাধ্যম। সেই দিনের আশায় সাংবাদিকরা ।

সময় দেখার প্রয়োজন হলে ঘড়ি দেখতে হয়। হাতে যদি ঘড়ি না থাকে, আগে ঘড়ি খুঁজতে হবে; অতঃপর সময় দেখতে হবে অথবা কাউকে-না-কাউকে সময় জিজ্ঞেস করতে হবে। সময় দেখার পর যদি ওই সময়ের কাজটি করা না হয়, তার জন্য ‘সময়’ দায়ী নয়। দায়ী যিনি সময় দেখলেন না অথবা যিনি দেখার পরও অবহেলা করলেন। অবহেলার মূল্য পৃথিবীর বহু দেশ, সমাজ, জাতি ও ব্যক্তি দিয়েছে।

আশার কথা, সংবাদ মাধ্যমগুলোর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় মনযোগী হয়েছে, তারা সব প্রতিকূলতার মাঝেও ভালোভাবে টিকে আছে। তারা নাগরিক সমাজের তথ্যচাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছে। সাদাকে সাদা বলা এবং কালোকে কালো বলার সাহস ও সততা লালন খুবই দরকার সাংবাদিকদের জন্য। এর জন্য সবার আগে দরকার সুশিক্ষা।

লেখক : নাসির উদ্দিন,

ইমেইল : [email protected]

পূর্বকোণ/মামুন/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট