চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং বিশ্বজিৎ চৌধুরী

মোসতাক খন্দকার

১৬ এপ্রিল, ২০২১ | ১:৫০ অপরাহ্ণ

২৮ মার্চ থেকে আমার খারাপ লাগা শুরু হয়। ২৯ মার্চ আমার শরীরের উপসর্গগুলোর সাথে ডাক্তার, পত্র-পত্রিকার কথা এবং ফেসবুক ডাক্তারদের (ডিগ্রিছাড়া) বাণী মিলিয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে, আমি কোভিড আক্রান্ত। ৩১ মার্চ আমার অফিসের মেডিকেল অফিসার এবং ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের দুজন খ্যাতিমান চিকিৎসক আমার সাথে আলাপ করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আমাকে জানালেন আমি করোনায় আক্রান্ত এবং আমাকে দ্রুত কোভিড টেস্ট করাতে বললেন। আমি আমার একজন অত্যন্ত স্নেহাস্পদ সাংবাদিক ভাইয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে কোভিড টেস্ট করালাম।

দুদিন পরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হলো আমি সন্দেহাতীতভাবে করোনা রোগী। আমি তখন বিছানায় বুকের ব্যথা, চোখের ইনফেকশন আর মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আমার স্বভাবজাত প্রাণশক্তির মাধ্যমে একটু স্থির হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, আমার অসুস্থ রক্তচক্ষুর ঝাপসা দৃষ্টির সামনেও স্পষ্টভাবে একটা সাদা পর্দা ভেসে উঠলো। আর তাতে একের পর এক দৃশ্যায়িত হতে লাগলো গত এক বছরে আমার অশ্রুসিক্ত অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত আমার ভাই ও অগণিত মানুষের মুখ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের সরাসরি ঠিকানা হয়েছে আইসিইউ এবং সেখান থেকে লাশ হয়ে ঘরে ফেরা।

মনোবল হারালে এই রোগ আরো বিধ্বস্ত করে দেবে — অনেকের সহানুভূতিশীল এই কথাও মনে পড়লো। আমার সমস্ত ইচ্ছে-শক্তিকে জড়ো করে বালিশ থেকে মাথাটা তুলে একটু হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করলাম। আইসিইউ, মৃত্যু, লাশ, শ্বাসকষ্ট, পাল্স অক্সিমিটারের রেখার ৯০ এর নিচের দিকে ধাবিত হওয়া ইত্যাদি অসহনীয় দৃশ্যগুলো থেকে মন ও মনোযোগকে দিকভ্রান্ত করার জন্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিছু একটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হাতের কাছেই ছিল শ্রীজাত’র ‘যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’, ড. মোহাম্মদ হান্নান সম্পাদিত ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

কবি ও কোবিদ’ এবং প্রথম আলোর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী ম্যাগাজিন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’। একেবারেই অপঠিত বলে প্রথম আলোর ম্যগাজিনটাই হাতে তুলে নিলাম। দেহ-মনের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আমার চোখকে সূচিপত্রে ভ্রমণ করতে দিলাম। দেখলাম আগ্রহ ও মনের অনেক ভারি, হালকা ও সুস্বাদু খাবারের তালিকা। দ্রুত শেষ করা যায় এমন কিছুই খুঁজছিলাম। কবিতার পাতায় গিয়ে হতাশ হলাম। সবই বহুলপঠিত জনপ্রিয় কবিতা। আবার সূচিপত্র দেখলাম। সাইমন ড্রিং, মঈদুল হাসান, রফিকুল ইসলাম হয়ে চোখ আটকে গেল বিশ্বজিৎ চৌধুরীতে। কবিতা নয়, গল্প লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে আমার আত্মদ্বন্দ্বের অবসানের কথা পরে বলছি। গল্পের শিরোনাম — “মা তোর বদনখানি”। শিরোনাম দেখেই আগ্রহে মনটা ভরে গেল। কারণ জাতীয় সংগীতের এই অংশটি আমার খুব হৃদয়ছোঁয়া প্রিয় অংশ। যাহোক, শুরু করলাম গল্প পড়া। ‘আপনি কি আমার মাকে ভালবাসতেন?’ — হোয়াট এ্যা ড্র্যামাটিক বিগিনিং। হোয়াট এ্যা ওয়ার্ম রিসিপশন টু এ রিডার। এক দারুণ উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে পাঠককে নিয়ে গেল গল্পের অন্দরমহলে। শব্দ আর বাক্যের পরতে পরতে নাটকিয়তা। পাঠককে আগাম কিছু ভাবার অবকাশই দেন নি গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী। বহতা নদীতে অনুকুল স্রোতে পাঠককে নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে গেছেন এক অজানা ঘাটে। অনেক গবেষক, কবি, কথাসাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধের এই অনাবিষ্কৃত ঘাটের সন্ধান দিতে না পারলেও এই ঘাট একাত্তরের অন্ধাকারাচ্ছন্ন বাস্তবতা। যেখানে বিশ্বজিৎ চৌধুরী আলো ফেলে দেখিয়েছেন। আর গল্পের জয়া হচ্ছে সেই অকথিত বাস্তবতার প্রতিনিধি-কথক।

লেখক তার পরিপক্ক সৃজনশৈলী দিয়ে পাঠকের বোধের জগতে পুলক জাগিয়েছেন একাধিকবার। গল্পের বুননের পরম্পরায় জয়ার মুখে শারমিন বা মায়ার মৃত্যুর সংবাদ, আশরাফের জন্য মায়ার চিঠি, আবদুল ওয়াহাবের পরিচয় জানা ইত্যাদি ঘটনার অভিনবত্ব পাঠককে কৌতূহলের প্রান্তসীমায় নিয়ে গল্পের যবনিকার শেষ শব্দটি পর্যন্ত গভীর মনোনিবেশের সাথে পড়তে বাধ্য করে। আমার মত করোনা আক্রান্ত পাঠকও চরম সহিষ্ণুতা নিয়ে প্রতিটি শব্দের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যাই গল্পের শেষ পৃষ্ঠায়।

আর এখানেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল ঘোরলাগা বিস্ময়, বিস্মিত-আনন্দ। একজন পাঠক হিসাবে এতটা আনন্দিত হলাম যখন দেখলাম গল্পকার তার কাহিনী বুননের মুন্সিয়ানায় এবং সৃজনের চমৎকারিত্বে আশরাফ ও শারমিনের একে অপরকে ভালবাসার প্রকৃত সত্যটা পাঠককে জানান দিল। একজন পাঠক হিসাবে অত্যন্ত আবেগতাড়িত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি যখন গল্পকার জয়াকে মুক্তিযোদ্ধা শাহরিয়ারের মেয়ে দেখিয়ে গল্পের ইতি টানেন। এই অজ্ঞাত সত্যটি জেনে উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে জয়া যখন বলে– ‘উড ইউ প্লিজ গিভ মি আ হাগ?’ তখন জয়ার কান্নার তোড়ে এই করোনা আক্রান্ত পাঠক আমি গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরীকে হাগ করার অদম্য বাসনায় প্রথম আলোর ম্যাগাজিনটাকে বুকে চেপে ধরি। আর মনে মনে ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ গাইতে গাইতে অঝোরে কাঁদতে থাকি।

জয়ার আলিঙ্গনে শারমিনের সান্নিধ্যের বিভ্রমের কথা পড়ে নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির মত করে বলতে ইচ্ছে করছে– আশরাফ শারমিনকে পায় নি, শারমিন আশরাফকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমকে পায়নি।

শরীরের সব কষ্ট আর মানসিক অস্থিরতাকে ভুলে মাথা তুলে দাঁড়ালাম। হৃদয়ের এক গভীরতর প্রদেশ থেকে এক দারুণ ভাললাগা আমার মধ্যে কেমন যেন এক প্রশান্তির স্থিরতা এনে দিল।

আমার এ কান্না কষ্টের নয়, আনন্দের। আশরাফের ভালবাসার স্বীকৃতি আর জয়ার প্রকৃত পিতৃপরিচয় প্রাপ্তিতে একজন সরল পাঠকের এই আনন্দাশ্রু। একটি ছোট গল্পে লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর দেশাত্মবোধের সৃজনবৈচিত্র্যের মুগ্ধতায় আমারও জয়ার মত তাকে হাগ করতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো তাকে মোবাইলে কল করে অঝোরে কাঁদতে থাকি। কিন্তু গল্পের ভেতরে ঢুকে বুঁদ হয়ে থাকা আমার মন আর করোনার ভোগান্তিতে অবসাদগ্রস্ত আমার আঙুল বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মোবাইল নাম্বারের ডিজিটে রাখতে পারলোনা।

ওই যে শুরুতেই একটু তির্যকভাবে বলেছিলাম বিশ্বজিৎ চৌধুরী কবিতা নয় গল্প লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি আমার আত্মদ্বন্দ্বের অবসানের কথা বলবো বলেছিলাম। সেই বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। বিশ্বজিৎ চৌধুরী আমার বাছাই করা প্রিয় কবিদের একজন। ১৯৮৬ সাল থেকে আমার আবৃত্তির প্রায় চার সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে আমি তার কবিতার আবৃত্তি শিখিয়েছি। যখনি আমার কোন মৌলিক বা সম্পাদিত গ্রন্থ ও আবৃত্তির সিডি প্রকাশিত হয়েছে আমি তার একাধিক কবিতা নিয়েছি। বাংলাদেশ ও কোলকাতার কবিতার সংকলন কিনি তখন আমার ক’জন প্রিয় কবির তালিকায় তার নামটাও সূচিতে আছে কিনা দেখি। এত কথা বলার কারণ একটাই। আমি তাকে বারবার কবি হিসেবেই দেখতে চেয়েছি। কবি হিসেবেই ভালবেসেছি। তাই তার গদ্য, গল্প ছাপার অক্ষরে ঘনঘন পত্র-পত্রিকায় আমার পছন্দ হচ্ছিল না।

এখানে বিষয়টা মানের নয়, অভিমানের। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বয়সে আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। তাই ব্যাপারটা ঈর্ষারও নয়, আশঙ্কার। তার কবি-পরিচয় ঢাকা পড়ে যেতে পারে, কবিতা-বিমুখ হতে পারেন কিংবা কবিতা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে এই ভেবে শঙ্কিত এবং আত্মদ্বন্দ্বে আক্রান্ত ছিলাম। আমার এই আত্মদ্বন্দ্বের অবসান হতে বেশি সময় লাগেনি। আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগের কথা। আমি জানতাম বিশুদা নজরুল ও নার্গিস নিয়ে কাজ করছেন। তিনিই আমাকে বাতিঘরে জানালেন নার্গিসকে নিয়ে লিখা উপন্যাসটি প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় আসছে।

আমি ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলাম। আমাকে তার এই বিশেষভাবে বলা এবং উচ্ছ্বাসের একটা কারণও আছে। যাহোক, কিছুদিন পর প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা কিনে নিলাম এবং এক অখণ্ড অবসরে গোগ্রাসে নার্গিস উপন্যাসটি শেষ করলাম। সেদিন বাসায় কারো সাথে তেমন একটা কথা বলিনি, এক ধরণের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ছিলাম। মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল বিশ্বজিৎ, নজরুল, নার্গিস…….। বিশুদা আর থেমে থাকেন নি। একে একে লিখে ফেললেন ‘বাসন্তী, তোমার পুরুষ কোথায়?’, ‘হে চন্দনা পাখি’, ‘দূর-সম্পর্ক’, ‘ফুটো’ ‘কবি ও রহস্যময়ী’ নামে দারুণ সব উপন্যাস। আমার আত্মদ্বন্দ্বের অবসান হলো এই ভেবে যে, এটা তো নিছক আর্থিক লাভালাভের বিষয় নয়, ইগো নয়, কবিত্বকে বিসর্জন নয়।

এ এক নতুন সৃজনের নেশা, সাহিত্যের আরেক শাখায় সার্থকভাবে বিচরণের তৃপ্তি। যা অনেক কবিকে দিয়ে হয় নি। কবিতার শৈল্পিক আড়াল, বিমূর্ততা, পরাবাস্তবতা ইত্যাদি গল্প-উপন্যাসে আরোপ করতে গিয়ে অনেক কবি হোঁচট খেয়েছেন। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর অন্য উপন্যাসগুলো বাদ দিয়ে যদি ‘নার্গিস’ আর ‘কবি ও রহস্যময়ী’ — এই দুটো উপন্যাসের কথা বলি তাহলে বলবো নজরুলের জীবনের দুজন আলোচিত নারী নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ববহ কাজ। যার জন্যে সাহিত্য-গবেষণার অনার বোর্ডে, ইতিহাসের মার্বেল পাথরে লেখকের নামটি খোদাই করা থাকবে। এ দুটি নিঃসন্দেহে গবেষণামূলক কাজ। এর জন্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী দুটো পিএইচ.ডি ডিগ্রি পাওয়ার দাবি রাখেন।

এ দুটি কাজে খুব লক্ষণীয় ও প্রশংসনীয় দিক ছিল লেখকের নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির নান্দনিক প্রতিফলন।

অনেক আগেই বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গলায় একুশ, বাংলা একাডেমী, স্বাধীনতা পদক ঝোলা উচিত ছিল। কিন্তু পত্র-পত্রিকা, প্রকাশক এবং পুরস্কারদাতাদের লবিস্টরা যুক্তিহীন ও অর্থহীনভাবে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, মানিক বা আবু ইসহাকের বারবার পুনঃসংস্করণকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও ফোকাস করায় তা আর হয়ে ওঠেনি। অথচ নজরুলের জীবন নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ুন আহমেদের দুটি ছোট গল্প আর কোলকাতার একজন লেখকের (নাম মনে পড়ছে না) একটি উপন্যাস ছাড়া বিশ্বজিতের এমন মৌলিক, গবেষণামূলক, সৃজনশীল কাজ একটিও নেই।

পরিশেষ কৈফিয়ত : করোনায় শয্যাগত হয়ে এই নাতিদীর্ঘ রচনা। তাই বলে এই কথামালায় আবেগের আতিশয্য নেই। আবেগের অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস নেই, আবেগের পরিমিত প্রয়োগ আছে। আমি আমার নিখাদ অনুভূতি প্রকাশ করেছি মাত্র। বিশুদার হৃদয়ে আমার স্থান কতটুকু কিংবা আমাকে কিভাবে দেখেন আমি জানিনা। কিন্তু পূর্বকোণ পত্রিকায় চাকরি করার সময় এবং তারও আগে থেকে বিশ্বজিৎ, ওমর কায়সার প্রমুখ ক’জন কবি-সাংবাদিকের সাথে এবং তাদের সাহিত্যকর্মের সাথে আমার নিবিড় পরিচয়। কিন্তু কোনপ্রকার প্রাপ্তির আশায় তাদের সাথে কখনো কোন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হই নি। যোগ্যতার তুলনামূলক মাপকাঠিতে তাদের এক একজনের পত্রিকা থেকে আমার অনেককিছু প্রাপ্য থাকলেও কখনো তাদের বিরুদ্ধে বঞ্চিত করার অভিযোগ উত্থাপন করি নি। নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসে গেছি।

দেড় বছর বিশুদার সাথে দেখা নেই, কথা নেই। আগে মাঝেমাঝে কল করতেন, অফিসে ডাকতেন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট