চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রমজানের রাতে ইবাদতকারীদের পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করবেন আল্লাহ

১৪ এপ্রিল, ২০২১ | ৩:৫১ অপরাহ্ণ

রমজান মাস হলো সিয়াম সাধনার মাস, ইবাদতের মাস। প্রতিটি দিন যেমনি আমাদের কাছে দামী ঠিক তেমনি প্রতিটি রাতকেও আল্লাহ মর্যাদা দিয়েছেন। তাই রমজান মাসে ইবাদতের মূল্য বেশি। দিনের বেলায় রোজা রাখা ফরজ। রাত জেগে ইবাদত সুন্নত। দিনে রোজা রাতের বেলায় সুন্নত আদায়ের জন্য তারাবির নামাজ দিয়েছেন আল্লাহ’তায়ালা।
তারাবি শব্দ তলবিয়া শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হলো আরাম বা বিশ্রাম নেওয়া। হাদীসের মধ্যে এই শব্দ এসেছে। মুহাম্মদ (সা) ৪ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ে পরে আরাম নিতেন। সেই কারণে এই নামাজের নাম হলো তারাবি। তাই তারাবির নামাজের মধ্যে প্রতি ৪ রাকাত পর কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেয়া উত্তম। সারাদিন রোজা ও কাজ শেষে সাহাবায়ে কেরাম ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তাই এভাবে ধীরে ধীরে বিশ্রাম নিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করতেন।

হাদীসের মধ্যে রাসুল (সা) ইরশাদ করেন, রমজান মাসে যারা কিয়ামে রমজান করবে, অর্থাৎ রমজানের রাতে ইবাদত করবে, আল্লাহপাক তাদের পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করবেন। রমজানে অতিরিক্ত নফল নামাজ এশার নামাজের পরেও হতে পারে, আবার ফজরের আগেও হতে পারে। রাতের প্রথম অংশের নাম হলো তারাবি এবং শেষের অংশের নাম দেওয়া হয়েছে তাহাজ্জুদ বা কেয়ামুল লাইল। তারাবি শুধু রমজানে হয় আর তাহাজ্জুদ সারাবছর পড়তে হয়।

মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়ত লাভের ৩ বছরের মাথায় নবীর জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ ফরজ ছিল। একবছর পর ফরজ বাতিল হয়। এরপর থেকে নফল হিসেবে সাহাবায়ে কেরাম তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। নবুয়তের ১১ বছরে মে’রাজের রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন আল্লাহপাক। তখন থেকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতের জন্য ফরজ হয়ে গেল। তাহাজ্জুদের নামাজ ইসলামের শুরু থেকে ছিল। তারাবির নামাজ ইসলামের শুরু থেকে ছিল না। তারাবির নামাজ এসেছে নবুয়তের ২২ বছর পর। যে বছর রাসুল (সা) ইন্তেকাল করেছেন সে বছর তারাবির নামাজ সুন্নত করে দেয়া হয়। অর্থাৎ দশম হিজরীতে।
তারাবির নামাজ প্রথম থেকে সুন্নত। তাহাজ্জুদের নামাজ প্রথম ৩ বছর ফরজ ছিল। পরবর্তীতে ১ বছর নফল হলো। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হবার পর আবার সুন্নত হিসেবে স্থির হলো। আল্লাহ কোরআন শরীফে তাহাজ্জুদের নামাজের অনেক মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। মুমিনরা আল্লার কাছে ক্ষমা চায় তাহাজ্জুদের সময়। মুমিনরা শেষ রাতে উঠে আল্লাহপাকের জিকির করে। শেষ রাতের দিক আল্লাহপাকের কাছে বেশি প্রিয়। সবচেয়ে বেশি দোয়া কবুল হয় এই সময়ে।

আল্লাহ বলেন, ‘আমার কোন বান্দা আছে কি, আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার। আমি তাকে ক্ষমা করবো। রিজিক তালাশ করলে তাকে রিজিক দেব। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবো।’

মুহাম্মদ (সা) বলেন, ৬টি সময়ে বেশি দোয়া কবুল হয়। এর পাঁচটি হলো ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর আর ৬ষ্ঠটি হলো শেষ রাতের মধ্যে তাহাজ্জুদের সময়। সেই দোয়া আল্লাহ বেশি বেশি কবুল করেন। তাই এই তাহাজ্জুদের নামাজ উম্মতের জন্য সুন্নত হলেও নবীর জন্য ওয়াজিব ছিল। আল্লাহপাক বলেন, হে আমার হাবীব শেষ রাতের মধ্যে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করুন। আল্লাহ আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছে দেবেন। সুবহানাল্লাহ। তাই নবীজি প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন।

মুহাম্মদ (সা) জীবনে জামায়াতের সহিত তারাবির নামাজ আদায় করেছেন ৩ বার। হাদীসের মধ্যে এসেছে- একদিন রমজানে ঘোষণা করলেন তিনি আজ রাতে তারাবির নামাজ আদায় করবো। ২৩ তারিখ জামায়াতের সহিত রাতের এক তৃতীয়াংশ তারাবির নামাজ আদায় করলেন। ২৪ তারিখ পড়েননি। ২৫ তারিখ আবার সাহাবীদের নিয়ে অর্ধরাত পর্যন্ত তারাবির নামাজ আদায় করলেন। এরপর দিন পড়েননি। আবার ২৭ তারিখ রাতে এশার পর শুরু করে ফজরের ২০ মিনিট আগে তারাবির নামাজ শেষ করলেন। সেই সময় নবী বলেছিলেন, নিয়মিত জামায়াতে পড়াচ্ছি না এ জন্যে, যদি নিয়মিত জামায়াতে পড়াই প্রত্যেক রমজানে জামায়াতে পড়াটা ফরজ হয়ে যাবে। সেই আশংকায় আমি তোমাদের জামায়াতে পড়াচ্ছি না। তখন কেউ বাড়িতে পড়তো, কেউ মেসজিদে আদায় তারাবি আদায় করতো। পরের বছর তিনি ইন্তেকাল করেন। সেই সময় সাহাবীদের অভ্যাস ছিল তারা তারাবির নামাজ আলাদাভাবে ভাগ হয়ে পড়তেন। কেউ একা পড়তেন। কেউ কেউ মসজিদে ছোট ছোট জমায়েত করে আদায় করতেন। হযরত আবু বক্কর (রা)এর যুগেও একই ধারা প্রচলিত ছিল।

১৪ হিজরীতে হযরত ওমর (রা) যখন খলিফা হলেন। তখন তিনি দেখলেন মসজিদে নববীতে কয়েকভাগে আলাদা হয়ে তারাবির নামাজ আদায় করা হচ্ছে। তিনি পরামর্শ করলেন সকলকে যদি নামাজ আদায়ের জন্য একত্রে করে দিই, ভালো হবে। একজন সাহাবী বললেন, মুহাম্মদ (সা) মাত্র তিনদিন জামায়াতে তারাবি আদায় করেছেন। বাকী সময় ফরজ হওয়ার আশংকায় তিনি আদায় করেন নি। ওমর (রা) বললেন, এখনতো রাসূল (সা) নেই। রাসূল (সা) এর মতো আমরা জামায়াতে আদায় করলে আর ফরজ হওয়ার আশংকাও নেই। তাই একজন ঈমামের পেছনে সবাই নামাজ আদায় করতে পারি। এরপর এক ঈমামের পেছনে তারাবির নামাজ চালু করলেন ওমর (রা)। সেটা ১৪ হিজরী থেকে আজ পর্যন্ত সুন্নত হয়ে আছে।

একসাথে ২০ রাকায়াত তারাবির নামাজ পড়ার বিধান চালু করেন ওমর (রা)। এখন প্রশ্ন আসতে পারে মুসলিমরা ওমর (রা) বিধান মানবে কিনা? হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী তা মানতে বাধ্য। কারণ রাসূল (স) বলেছেন, আমি এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদীন যে কাজের অনুমোদন দেবে সেটাও আমার সুন্নত। সেটাও তোমরা পালন করবে।

কারণ হাদীসের মধ্যে নবী বলেছেন, আমার সুন্নতকে তোমরা গ্রহণ করো। সেই মোতাবেক ওসমান (রা) এর ৩০ প্যারা পবিত্র আল কোরআন সংকলনকে আমরা আর বিদয়াত বলিনা। এটা রাসূল (স) অনুমোদন দিয়েছেন। রাসূল (স) অন্যদেরটা গ্রহণ করতে বলেননি, খোলাফায়ে রাশেদীনেরটা গ্রহণ করতে বলেছেন। তাই ওমর (রা) যে তারাবি চালু করলেন সমস্ত বিশ্বের মুসলিম তা অনুসরণ করেন।

ওমর (রা) ২০ রাকায়াত তারাবির নামাজ পড়ার বিধান চালু করলেন। এখন আমার মতানৈক্য করি। তারাবি আসলে কয় রাকাত? যারা ৪ মাযহাবকে অস্বীকার করেন তারা বলেন, তারাবির নামাজ ৮ রাকাত। কিন্তু ৪ মাযহাবের শীর্ষ ঈমামদের মত হলো-২০ রাকাত। তবে ঈমাম মালেকের অভিমত হলো-২০ রাকাত জামায়াতের মাঝখানের বিরতিতে আরো ১৬ রাকাতসহ ৩৬ রাকায়াত পড়া যাবে। নামাজের বিরতিতে ব্যাক্তিগত আমল সুন্নত।

মক্কা শরীফে তারাবির ৪ রাকাত শেষে বিরতির সময় কাবা শরীফ তওয়াফ করা হতো। মদীনা শরীফে সে সুযোগ নেই। বিরতির সময় তাই তারা নফল নামাজ পড়ে নিতেন ৪ রাকাত। হযরত ঈমাম মালেক মদীনা শরীফে থাকতেন। সেই কারণে ৪ রাকাত করে ১৬ রাকাত নফলসহ ৩৬ রাকায়াত পড়তেন।

সবাই একমত ২০ রাকায়াত তারাবির নামাজ পড়া সুন্নত। এখন রাসূল (স) কয় রাকাত পড়েছেনে তা স্পষ্ট নয়। একটি হাদীসে এসেছে রাসূল (স) তারাবির নামাজ ৮ রাকাত পড়েছেন। অপরটিতে এসেছে তিনি ২০ রাকাত পড়েছেন। দুটি হাদীসই দুর্বল। কোন সহীহ হাদীস দ্বারা রাসূল (স)কয় রাকায়াত পড়েছেন তা স্পষ্ট নয়।

আহলে হাদীসরা একটি বোখারী শরীফের হাদীস দিয়ে বললেন, আয়েশা (রা) বলেছেন- রাসূল (স) গায়েবে রমজানে ৮ রাকাতের বেশি পড়তেন না, ৪ রাকাত করে পড়তেন। গায়েবে রমজান মানে রমজান ছাড়া বাকী ১১ মাস। এটা তারাবি নয়, তাহাজ্জুদের নামাজ। তারাবি গায়েবে রমজানে হয় না। শুধু রমজানে হয়। আয়েশা (রা) এমন নামাজের কথা বলেছেন, যার সারব্স্তু হলো- তাহাজ্জুদের নামাজ।

ঈমাম বোখারী (রা) এর জীবনীতে এসেছে, তিনি রমজানে কোরআন ৪১ খতম করতেন। কিভাবে করতেন? প্রত্যেকদিন দিনের বেলায় এক খতম। ছাত্রদের নিয়ে তিনি এশার নামাজের পর ৩০ রমজানে এক খতম করতেন। একাকি তাহাজ্জুদের সময় তিনদিন মিলে এক খতম করতেন। ৮ রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজে। তিনদিনে এক খতম ৩০ দিনে ১০ খতম। এতে সহজেই বুঝা যায়, ৮ রাকাত তারাবির ব্যাপার নয়, তা ছিল তাহাজ্জুদের ব্যাপারে।

দুই রাকাত করে তারাবীহ নামাজ আদায় করতে হয়। দুই দুই রাকাত করে প্রতি ৪ রাকাআত পরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়। বিশ্রামের এ সময়টিতে তাসবিহ-তাহলিল ও আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়।

তারাবির বহু প্রচলিত একটি দোয়া: ‘সুবহানাজিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাজিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’

তারাবির নামাজ কমপক্ষে ২০ রাকায়াত পড়া সুন্নত। ওযর থাকলে কম পড়তে পারেন। রমজানে একটি নফলে আল্লাহ ফরজের সওয়াব দান করেন। একটি ফরজকে ৭০টি ফরজের মর্যাদা দান করেন। যত বেশি ইবাদত করবো ততবেশি আমাদের জন্য উত্তম। তারাবি ছোট করা রাসূল (স)এবং সাহাবীদের সুন্নাহ বিরোধী। সেই কারণে কম পড়ার চেষ্টা করবোনা। তবে করোনার কারণে গত বছর সৌদি আরবে কম পড়া হয়েছে ১০ রাকাত। এবারও একই সিদ্ধান্ত সৌদি আরবের।
আল্লাহ আমাদের সকলকে তারাবির নামাজের গুরুত্ব বুঝার এবং নেক আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক:  ব্যুরো চিফ, চট্টগ্রাম, বাংলাভিশন।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট