চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

এক জাতি দেখলাম, গালিও দেয় বুক ফুলিয়ে…!

১১ এপ্রিল, ২০২১ | ৫:২৮ অপরাহ্ণ

আয়ারল্যান্ডের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন ডে ছিলো শনিবারে। ভাবলাম এসেছি যখন কিছু স্মৃতিতো নিয়ে যাই। রাস্তায় লোকজন ধরে নিজের কিছু ছবি তুললাম। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আয়ারল্যান্ড, মেনুথ। মেনুথ আয়ারল্যান্ডের একটি ছোট শহর, মাত্র ১৫ হাজার লোকের বসবাস এই শহরে। তবে ইউনিভার্সিটির সেমিস্টারে জনসংখ্যা বেড়ে যায় অনেকটা। বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টির কারণে শহরটিকে ‘ইউনিভার্সিটি টাউন’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে ।

আয়ারল্যান্ড ইউরোপের ছোট একটি দ্বীপ যার এক-ষষ্ঠাংশ এখনো ব্রিটেনের অধীনে, উত্তর আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল দীর্ঘদিন। মাত্র ১৯২১ সালে দেশটি স্বাধীন হয় এবং আইরিশ রিপাবলিক নামে পরিচিতি লাভ করে।

ছোট দেশ আয়ারল্যান্ডের আয়তন মাত্র ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। বলা যায় আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের সমান। লোকসংখ্যা পঞ্চাশ লাখের কাছাকাছি। চারপাশ ঘিরে আছে অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, বেশ কয়েকটি নদ নদী আর হ্রদে। দক্ষিণে ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর; আড়াই হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করলেই আমেরিকা। এর মাঝে আর কোনো দেশ নেই। পূর্বে আইরিশ সাগর। উত্তরে উত্তর সাগর।

যুদ্ধ, অনুপ্রবেশ এবং দারিদ্র্যের জন্য সাহিত্য আর সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো শাখায় আাইরিশদের তেমন কোন সাফল্য ছিল না। তবে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর পর থেকে আয়ারল্যান্ডের প্রতিভাধরেরা দেশটিকে বিশ্ব মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।

আয়ারল্যান্ড স্বাধীন হয় ১৯২১ সালে। ১৯২৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডে নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৯ জন। চারজন সাহিত্যে, চারজন রাজনীতিতে, এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে একজন আইরিশ যুবক এক চীনের নারীসহ মেডিসিনে নোবেল্প্রাইজ শেয়ার করেন।

দেশ স্বাধীন হয় ১৯২১ সালে, ১৯২৩ সালে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের নোবেল বিজয় দিয়ে শুরু হয় এদেশের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের ইতিহাস। এর দুবছর পরই ১৯২৫ সালে জর্জ বার্নাড শ, ১৯৬৯ সালে স্যামুয়েল বেকেট, ১৯৯৫ সালে শেমাস হিনি আইরিশ সাহিত্যে নোবেল বোয়ে আনেন।

আইরিশ সাহিত্য বরাবরাই সমৃদ্ধ। সাহিত্য ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হওয়ার জন্য নোবেল পুরস্কার যে কোনো অত্যাবশ্যকীয় শিরোপা কিংবা খেতাব নয় তা এদেশের লোকের মনমানসিকতা দেখলে বোঝা যায়। এ দেশের মানুষের কাছে জয়েস সর্বকালের সেরা সেলিব্রেটি। ডাবলিনের ছেলে জেমস জয়েস। একজন লেখকও যে একটি জাতির কাছে রাজনীতিবিদ কিংবা সিনেমার সেলিব্রেটি নায়ক নায়িকদের ছাপিয়ে বেশি জনপ্রিয় হতে পারে তা ডাবলিনে আসলে বোঝা যায়। জয়েস কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাননি। জেমস জয়েস ১৯১৪ সালে ডাবলিন শহরের মধ্যবিত্তের জীবন যাপনকে উপজীব্য করে ১৫টি গল্প নিয়ে ডাবলিনার নামে এই গল্প গ্রন্থ লিখেছিলেন। এই শহরের এমন কোনো গিফট শপ নেই যেখানে জয়েসের ছোট বড় প্রতিকৃতি কিংবা ভাস্কর্য বিক্রি হয় না। তারা বারবার মনে করিয়ে দেবে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস “ইউলিসিস” লেখা হয়েছে এই ডাবলিন শহরকে ঘিরে।

এছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, অলিভার গোল্ডস্মিথ, বুকার প্রাইজ বিজয়ী লেখিকা অ্যানি এনরাইট, জেনিফার জনস্টোন, রক্তপায়ী ভ্যাম্পপায়ারের স্রষ্টাও কিন্তু একজন আইরিশ। ব্রাম স্টোকার, (ড্রাকুলা) নামের হরর উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৮৯৭ সালে। গ্যালিভার ট্রাভেলসের লেখক জোনাথান সুইফট্ ও আইরিশ। এছাড়াতো আরো প্রচুর লেখক আছেন যা লিখে শেষ করা অসম্ভব।

আয়ারল্যান্ডের নামকরা পত্রিকা আইরিশ টাইমসের সম্পাদক ফিনটান ও টুলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এতো ছোট একটি দেশে, যেখানে জনসংখ্যা ও এতো অল্প, কি করে এতো অল্প সময়ে এতো প্রতিভা জন্মালো? হোয়াট মেইড আইরিশ রাইটার সো স্পেশাল?

ফিনটান বলেছেন, আমরা যা কিছুই করি নিজেদের সংস্কার আর মূল্যবোধকে ঘিরেই করি। আমরা যেকোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার আগে বারবার পিছনে ফিরি, ইতিহাস পর্যালোচনা করি, আমরা কে তা বারবার স্মরণ করি। যখন যারাই এদেশ আক্রমণ করতে এসেছিলো, উপনিবেশ গড়েছিল, তাঁরা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি যাই রেখে গেছে, আমরা সবকিছুকে ধীরেধীরে আইরিশ করে তুলেছি। আইরিশনেসে বৈচিত্র্যতা যোগ হয়েছে, কিন্তু আমরা আইরিশরা বদলাইনি। এমনকি ইংরেজিকে পর্যন্ত আমরা নিজেদের করে তুলেছি। লোকে যখন আমাদের বলে আমাদের কথা কিছু বোঝেনা, আমরা ভীষণ গালাগালও করি, আমরা গর্বের সাথে বলি, “F**k Off”, দ্যাটস হোয়াট মেইক্স আস আইরিশ।

এই এক জাতি দেখলাম, গালিও দেয় গর্বের সাথে, বুক ফুলিয়ে…!

লেখিকা: ফেরদৌসী বিকন, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট