সাদা রঙের ভক্সওয়াগন গাড়িটা ছিল বাবার প্রথম গাড়ি। ২৩ বছর আমাদের পরিবারের সাথে ছিল। হঠাৎ একদিন বিক্রি করে দিলেন। তার বদলে আসলো নতুন আরেকটা গাড়ি। নতুন গাড়ির আনন্দে পুরনো ভক্সওয়াগনটা ভুলে যেতে কয়েক মিনিট লেগেছিলো হয়তো ।
তবুও মাঝে মাঝে রাস্তায় স্ব-যত্নে তুলে রাখা কারো ভক্সওয়াগন গাড়ি চোখে পড়লে চিৎকার দিয়ে উঠতাম -ইশশ! আমাদের এরকমই একটা ছিল। ভক্সওয়াগন .. ব্যাংগাড়ি …। যে গাড়িটা নিয়ে কলেজে যেতে আমার এক বোন লজ্জা পেত। ড্যাহ ড্যাহ শব্দ করে গাড়িটা কলেজে ঢুকলেই ছেলেরা নাকি খেপাতো। বোন তাই অনেক দূরে নেমে হেঁটে কলেজে ঢুকতো ।
আর আমি? ড্রাইভারকে দশ টাকা ঘুষ দিয়ে সিটের উপর বালিশ দিয়ে চালানো শিখতে চেয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে করে আমার মেয়েটাকে আমার শৈশবের দিনগুলো কেমন ছিল জানাতে। ইচ্ছে করে একটা ভক্সওয়াগন জোগাড় করি ।
মেয়েটাকে দেখাই আমরা ছোটবেলায় কেমন গাড়িতে চড়তাম। অনেক খুঁজে একটা পেলাম। আজ সকালে ওকে নিয়ে বের হই। কিছুটা ঘুরে চলে আসি মা’র বাসায়।
ভক্সওয়াগনের কথা শুনে কেন যেন বাবাও নিচে নেমে আসেন। আমার মা, যিনি বিছানা থেকে নেমে মনে করেন অনেক দূর নেমেছেন। তিনিও সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসেন ।
কোইন্সিডেন্টলি আমার ৫ বোনও ঐ সময় মা’র বাসায় ছিল। সবাই নেমে এসে গাড়িটা ঘিরে দাঁড়ায় । একসাথে সবাই চলে যাই ছোটবেলায় ।
বাবা গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে মা বসা। আমরা পিছনের সিটে গাদাগাদি করে বসা আর ঝগড়া চলছে জানালার পাশে কে বসবে তা নিয়ে ।
বাবা হঠাৎ একটা ছড়া বলেন যেটা নাকি আমার এক বোন গাড়িতে উঠলেই বলতো। বাবার এখনো মনে আছে।
সবার চোখে দেখছিলাম রূপোলি ঝিলিক। নতুন গাড়ির ধাক্কায় আমাদের প্রথম গাড়িটা হারিয়ে গেলেও সবার মনেই যেন বেঁচে ছিল।
গাড়িটা যার কাছ থেকে কিনেছি ভদ্রলোক খুলনায় থাকেন। বৃদ্ধ, একা থাকেন । হোটেল থেকে খাওয়া কিনে খান। পুরো পরিবার তার বিদেশে। গাড়িটা বেঁচে উনিও চলে যাবেন তাদের কাছে ।
ওনারও হয়তো এমনি স্মৃতি ছিল.. অনেক সুখের। আমি সৌভাগ্যবান স্বার্থপরের মতো তার স্মৃতির টুকরোটা নিয়ে এসেছি আমাদের ফেলে আসা স্মৃতির পাজলটা কমপ্লিট করার জন্য। হয়তো উনি তার জীবনের বাকি সময়গুলো এই গাড়িটার কথা ভাববেন। আর আমি ব্যাস্ত থাকব আমার বাবাকে তার স্মৃতি গুলো ফিরিয়ে দিতে।
বাবা তুমি ভালো থেকো -আরো অনেক স্মৃতি এখনো ফিরিয়ে দেয়া বাকি।
পূর্বকোণ/এএ